বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে সম্প্রতি মার্কিন সংবাদপত্র দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে গত আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থানের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই প্রতিবেদন নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারা এটিকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে একটি বিস্তারিত ও নিরপেক্ষ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
উগ্রবাদের শঙ্কা ও সরকারের প্রতিক্রিয়া
‘প্রথম আলো’ জানিয়েছে, নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের উত্থানের শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। গত সোমবার রাতে অনলাইনে প্রকাশিত এই সংবাদে বলা হয়েছে যে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। তবে বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিবেদনকে ‘বিভ্রান্তিকর’ আখ্যা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনটি দেশের বর্তমান পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার প্রয়াস।
তথ্য উপদেষ্টার কঠোর অবস্থান
‘দৈনিক সংগ্রাম’ প্রকাশ করেছে যে, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের জবাবে স্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় উগ্রপন্থা মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না।” মাহফুজ আলম আরও জানিয়েছেন, প্রয়োজনে সরকার এ বিষয়ে ‘হার্ডলাইন’ বা কঠোর নীতি গ্রহণ করতে প্রস্তুত। তিনি প্রতিবেদনটিকে একপেশে বলে সমালোচনা করেছেন এবং এটি দেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতিকে উপেক্ষা করেছে বলে মনে করেন।
রিজভীর অভিযোগ
‘দ্য ডেইলি স্টার বাংলা’ জানিয়েছে, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের পেছনে আওয়ামী লীগের ‘দোসরদের’ হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের দোসররা তাদের অবৈধ টাকা দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশ করিয়েছে।” রিজভীর দাবি, এটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্রের অংশ।
পরাজিত শক্তির ভূমিকা
‘বাংলানিউজ২৪’ প্রকাশ করেছে যে, রুহুল কবির রিজভী আরও বলেছেন, “নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের পেছনে পরাজিত শক্তি কাজ করছে।” তিনি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এই মন্তব্য করেন। রিজভীর বক্তব্যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, যারা রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে, তারাই এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছে। তবে তিনি এই ‘পরাজিত শক্তি’ কারা, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি।
বার্গম্যানের সাফাই
‘যুগান্তর’ জানিয়েছে, নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন নিয়ে একজন বার্গম্যান নামে ব্যক্তি (সম্ভবত সাংবাদিক বা প্রতিবেদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ) সাফাই গেয়েছেন। প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা হয়েছে এবং এতে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরবর্তী পরিস্থিতির উল্লেখ রয়েছে। তবে ‘যুগান্তর’ এই সাফাইয়ের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি, শুধু উল্লেখ করেছে যে বার্গম্যান এই প্রতিবেদনের পক্ষে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
কে ইন্ধন দিচ্ছে?
‘ঢাকা পোস্ট’ প্রশ্ন তুলেছে, “নিউইয়র্ক টাইমসে বাংলাদেশ বিরোধী প্রতিবেদন, ইন্ধন দিচ্ছে কে?” এই সংবাদমাধ্যমটি ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি উক্তির উল্লেখ করেছে। ট্রাম্প বলেছিলেন, “সাংবাদিকেরা সবচেয়ে অসৎ প্রকৃতির লোক।” ‘ঢাকা পোস্ট’ ইঙ্গিত দিয়েছে যে, নিউইয়র্ক টাইমসের মতো প্রভাবশালী পত্রিকা অতীতেও ভুয়া তথ্য প্রকাশের অভিযোগে সমালোচিত হয়েছে। তারা প্রশ্ন করেছে, এই প্রতিবেদনের পেছনে কোনো গোপন উদ্দেশ্য বা শক্তি কাজ করছে কিনা।
অবৈধ টাকার অভিযোগ
‘ঢাকা মেইল’ জানিয়েছে, বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, “পরাজিত শক্তি নিউইয়র্ক টাইমসে মিথ্যা তথ্য দিয়ে রিপোর্ট করিয়েছে।” রুহুল কবির রিজভী এই অভিযোগ করে বলেছেন, “অবৈধ টাকা ব্যবহার করে পরাজিত শক্তি বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে।” তিনি এই প্রতিবেদনকে দেশের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
বিএনপির সংবাদ সম্মেলন
‘সময় নিউজ’ প্রকাশ করেছে, রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে রিপোর্ট করিয়েছে পরাজিত শক্তি।” তিনি আরও বলেন, “এটি বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করার একটি চেষ্টা।” রিজভী এই প্রতিবেদনের পেছনে অর্থের উৎস হিসেবে ‘অবৈধ টাকা’র কথা উল্লেখ করেছেন, যদিও তিনি এর কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেননি।
মাহফুজ আলমের ব্যাখ্যা
‘বাংলাদেশ জার্নাল’ জানিয়েছে, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “প্রতিবেদনে বলতে চাওয়া হয়েছে যে, শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার কারণে দেশে চরমপন্থা ও উগ্রপন্থার সুযোগ তৈরি হয়েছে।” তিনি এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মাহফুজ আলম মনে করেন, প্রতিবেদনটি বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
রিজভীর দাবি
‘বাংলা বার্তা’ প্রকাশ করেছে, রুহুল কবির রিজভী নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যা তথ্য’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি দাবি করেন, “পরাজিত শক্তি এই প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য অবৈধ টাকা ব্যবহার করেছে।” রিজভী আরও বলেন, এটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার একটি প্রচেষ্টা। তিনি এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ‘প্রথম আলো’ ও ‘দৈনিক সংগ্রাম’ সরকারের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছে, যেখানে এটিকে বিভ্রান্তিকর ও একপেশে বলা হয়েছে। অন্যদিকে, ‘দ্য ডেইলি স্টার বাংলা’, ‘বাংলানিউজ২৪’, ‘ঢাকা মেইল’, ‘সময় নিউজ’ ও ‘বাংলা বার্তা’ বিএনপির রুহুল কবির রিজভীর অভিযোগের কথা জানিয়েছে, যিনি এটিকে ‘পরাজিত শক্তি’র ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন। ‘জুগান্তর’ বার্গম্যানের সাফাইয়ের কথা উল্লেখ করেছে, আর ‘ঢাকা পোস্ট’ এর পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ‘বাংলাদেশ জার্নাল’ মাহফুজ আলমের ব্যাখ্যা প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতার জটিলতাকে প্রতিফলিত করে।