বাংলাদেশ সরকার প্রথমবারের মতো বিদেশি ঋণের মাধ্যমে সার আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সৌদি আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন’ (আইটিএফসি)-এর বৈঠকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চুক্তি হয়, যার মধ্যে ৫০ কোটি ডলার সার আমদানিতে ব্যবহৃত হবে এবং বাকি ৫০ কোটি ডলার জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বরাদ্দ থাকবে। এই সিদ্ধান্ত দেশের কৃষিখাত এবং সার সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।
বিদেশি ঋণের প্রয়োজনীয়তা
দেশের কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সার সরবরাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬৮ লাখ টন সার প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে ইউরিয়া সার ২৭-৩০ লাখ টন। স্থানীয় উৎপাদন কম হওয়ায় অধিকাংশ সারই আমদানি নির্ভর। তবে ডলার সংকটের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে সার আমদানিতে বিলম্ব হয়েছে, যা কৃষিখাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সার সরবরাহে স্থিতিশীলতা আনতে এবং কৃষি উৎপাদন সচল রাখতে এই ঋণ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। সরকারের দাবি, এই ঋণ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কৃষিখাতের উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
আইটিএফসির সঙ্গে চুক্তির বিশদ
আইটিএফসি মূলত ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইএসডিবি)-এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান, যা ওআইসি সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক অর্থায়ন করে। ২০২৪ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মোট ৩৬০ কোটি ডলার দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে ১৬০ কোটি ডলার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এবং ৫০ কোটি ডলার পাবে পেট্রোবাংলা।
জেদ্দায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী এবং আইটিএফসির পক্ষে চিফ অপারেটিং অফিসার নাজীম নূরদালি নেতৃত্ব দেন। বৈঠকে বাংলাদেশের খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এই অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়।
সার আমদানির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন অনেকাংশেই নির্ভর করে পর্যাপ্ত সার সরবরাহের ওপর। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে দেশীয় সার উৎপাদন কমেছে। ফলে আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে। তবে ডলার সংকটের কারণে সরবরাহকারীদের কাছ থেকে সার সংগ্রহে সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে বেশ কিছু বিদেশি সরবরাহকারী তাদের বকেয়া পাওনা মেটানোর নিশ্চয়তা না পাওয়ায় নতুন সরবরাহে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে।
এই পরিস্থিতিতে বিদেশি ঋণের মাধ্যমে সার আমদানি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। সরকারের মতে, এই অর্থায়ন সার সরবরাহ সহজ করতে এবং কৃষিখাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং সময়মতো পরিশোধ করাও গুরুত্বপূর্ণ হবে।
ঋণের শর্ত ও সুদের হার
আইটিএফসি থেকে পাওয়া এই ঋণের সুদের হার ১.৭৫% ধার্য করা হয়েছে, যা তুলনামূলকভাবে কম। এছাড়া ঋণের প্রশাসনিক ফি ০.২% নির্ধারণ করা হয়েছে। ঋণটিতে ৬ মাসের এসওএফআর প্লাস সুবিধা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা অর্থনীতির জন্য তুলনামূলকভাবে স্বস্তিদায়ক।
বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ-এর বার্ষিক সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আইটিএফসি প্রতিনিধিদের বৈঠকে আরও ২০০ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যা জ্বালানি ও সার আমদানির জন্য ব্যয় করা হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতি সচল রাখতে এবং কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সার আমদানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই ঋণ ব্যবহারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং সময়মতো পরিশোধ করাও জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধুমাত্র ঋণের ওপর নির্ভর না করে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যাতে দেশীয় সার উৎপাদন বাড়ানো যায় এবং আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব হয়। একই সঙ্গে, ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের কৌশলও গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সার আমদানির জন্য বিদেশি ঋণ গ্রহণ বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা। এই ঋণ কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে ঋণের সঠিক ব্যবহারের পাশাপাশি পরিশোধের বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে বড় কোনো অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি না হয়।
সরকারের এই পদক্ষেপ কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করবে সার আমদানি, বিতরণ ও ঋণ ব্যবস্থাপনার দক্ষতার ওপর। সময়ই বলে দেবে, বিদেশি ঋণ নির্ভর এই উদ্যোগ কৃষিখাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবে কি না।