গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর মধ্যে হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠক ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই বৈঠকে দুই নেতার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ফুটে উঠলেও, ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের সমাধান নিয়ে তাদের মধ্যে স্পষ্ট মতপার্থক্য প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো এই ঘটনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এবং সাধারণ সাংবাদিকের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিষয়ে একটি বিশ্লেষণ তৈরি করা হলো।
যুগান্তর শিরোনামে বলেছে, “ইউক্রেন নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে একমত নন ম্যাক্রোঁ”। তারা উল্লেখ করেছে যে ম্যাক্রোঁ ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন, যখন ট্রাম্প দ্রুত শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে ঝুঁকেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, “ট্রাম্প ম্যাক্রোঁ বৈঠক, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে ইউক্রেইন নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি”। এতে বলা হয়েছে, দুই নেতার মধ্যে বন্ধুত্ব থাকলেও তাদের পন্থা আলাদা।
বাংলাদেশ প্রতিদিন জানিয়েছে, “ইউক্রেন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার কথা জানালেন ম্যাক্রোঁন ও ট্রাম্প”। তারা দুই নেতার শান্তির প্রতি প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেছে, তবে পার্থক্যও উল্লেখ করেছে।
ডেইলি ইনকিলাব লিখেছে, “ইউক্রেন যুদ্ধের তিন বছর, দীর্ঘস্থায়ী শান্তি চায় রাশিয়া”। এতে রাশিয়ার অবস্থানের প্রতি ট্রাম্পের সমর্থনের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এই বৈঠক ছিল ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাগুলোর একটি। ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন তিন বছর পার করেছে। এই সময়ে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বন্ধের জন্য নানা প্রচেষ্টা চলছে, তবে কোনো স্থায়ী সমাধান এখনো পাওয়া যায়নি। এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প ও ম্যাক্রোঁর বৈঠকটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে ম্যাক্রোঁ জোর দিয়ে বলেন, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দেশটির সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা অপরিহার্য। তিনি মনে করেন, শান্তি কেবল একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি বা ইউক্রেনের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে হতে পারে না। তিনি রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেন। ম্যাক্রোঁর বক্তব্যে স্পষ্ট যে তিনি ইউক্রেনকে সমর্থন অব্যাহত রাখতে এবং রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চান। তিনি ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “পুতিনের মুখে দুর্বলতা প্রকাশ করা আপনার চরিত্রের সঙ্গে মানায় না। এটি আপনার স্বার্থেরও বিপক্ষে।”
অন্যদিকে, ট্রাম্পের অবস্থান ভিন্ন। তিনি ইউক্রেনে দ্রুত শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে। তার বক্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে এই সংঘাতের অবসান ঘটাতে চান। ট্রাম্প বলেন, “পুতিন যুদ্ধ বন্ধ করতে চান। আমি মনে করি, এটি শেষ করার সময় এসেছে।” তার এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর চাপ কমিয়ে এবং রাশিয়ার সঙ্গে একটি সমঝোতার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিতে আগ্রহী।
এই দুই নেতার মধ্যে পার্থক্য শুধু কৌশলগত নয়, বরং দৃষ্টিভঙ্গিরও। ম্যাক্রোঁ ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন, যেখানে ট্রাম্প দ্রুত ফলাফলের দিকে ঝুঁকছেন। এই মতভেদের মধ্যেও দুজনেই শান্তির প্রতি তাদের অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছেন। তবে তাদের পন্থা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে পশ্চিমা বিশ্ব এই সংকটে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনকে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে। তবে ট্রাম্পের প্রশাসন এই সহায়তার পরিমাণ কমিয়ে আলোচনার পথে হাঁটতে চায় বলে মনে হচ্ছে। এদিকে, ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে অনড়। এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প ও ম্যাক্রোঁর বৈঠক কূটনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রাম্পের দ্রুত শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রাশিয়ার জন্য সুবিধাজনক হতে পারে, কারণ এটি তাদের বর্তমান অবস্থানকে বৈধতা দিতে পারে। অন্যদিকে, ম্যাক্রোঁর অবস্থান ইউক্রেনের জন্য বেশি সহায়ক, তবে এটি যুদ্ধকে আরও দীর্ঘায়িত করতে পারে। দুই নেতার এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমা ঐক্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে ইউরোপীয় নেতারা আশঙ্কা করছেন যে, ট্রাম্পের নীতি তাদের বাদ দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে এককভাবে চুক্তির দিকে যেতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সংকটের প্রভাবও লক্ষণীয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করেছে। তাই এই বৈঠকের ফলাফল এই অঞ্চলের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রাম্প ও ম্যাক্রোঁর এই বৈঠক ইউক্রেন সংকটে নতুন মোড় আনতে পারে। তবে তাদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি শান্তি প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলতে পারে। আগামী দিনে এই দুই নেতা কীভাবে তাদের অবস্থানে সমন্বয় আনেন, তা বিশ্ব রাজনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ এই ঘটনার দিকে তাকিয়ে আছে, কারণ এর ফলাফল সবার ওপর প্রভাব ফেলবে।