স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন সম্প্রতি তাদের প্রাথমিক সুপারিশমালা প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে এই সুপারিশমালা তুলে দেন। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি এটি আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। এই সুপারিশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উঠে এসেছে, যা দেশের স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে আরও গণতান্ত্রিক ও কার্যকর করতে পারে।
প্রাথমিক সুপারিশে যা আছে
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সাহসী প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
– পৌরসভা বিলুপ্তির প্রস্তাব: দেশের বিভিন্ন পৌরসভা বিলুপ্ত করে স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে নতুনভাবে সাজানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
– সরকারি চাকরিজীবীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ: সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
– এমপিদের ক্ষমতা কমানো: স্থানীয় সরকারের ওপর সংসদ সদস্যদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব।
– নারী সদস্যদের ক্ষমতায়ন: সংরক্ষিত নারী সদস্যদের ভূমিকা ও ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিশেষ পদক্ষেপের সুপারিশ।
– স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার: স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
– জেলা পরিষদ শক্তিশালীকরণ: জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন জেলা পরিষদ বাতিলের সুপারিশ করলেও, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন এটিকে আরও শক্তিশালী করার পক্ষে মত দিয়েছে।
এছাড়া, কমিশন একই দিনে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন এবং জেলা পরিষদের নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে। এতে নির্বাচনি ব্যয় কমবে এবং প্রক্রিয়া সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সংবাদ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের এই প্রাথমিক সুপারিশ প্রকাশের পর সংবাদ মাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, “স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। পৌরসভা বিলুপ্তি ও সরকারি চাকরিজীবীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।” তারা আরও জানিয়েছে, এই প্রতিবেদন ২৪ ফেব্রুয়ারি সরকারের কাছে জমা পড়বে, যা বাস্তবায়িত হলে তৃণমূলের শাসন ব্যবস্থা নতুন রূপ পাবে।
‘প্রথম আলো’ তাদের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, “জেলা পরিষদ বাতিলের বিষয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সঙ্গে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের মতের অমিল দেখা গেছে। এটি শক্তিশালী করার প্রস্তাব স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব বাড়ানোর ইঙ্গিত দেয়।” তারা আরও বলেছে, জাতীয় নাগরিক কমিটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচন সরাসরি ভোটের পরিবর্তে ঘূর্ণমান পদ্ধতির প্রস্তাব দিয়েছে, যা নিয়ে আলোচনা চলছে।
‘বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর’ তাদের প্রতিবেদনে সুপারিশমালাকে “স্থানীয় সরকারে গণতন্ত্র ফেরানোর একটি পদক্ষেপ” হিসেবে উল্লেখ করেছে। তবে তারা এও বলেছে, “পৌরসভা বিলুপ্তির প্রস্তাব অনেকের কাছে অপ্রত্যাশিত। এটি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।”
‘বাসস’ রাজশাহী থেকে একটি সংলাপের খবর দিয়ে জানিয়েছে, “স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা তৃণমূলের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের মূল চাবিকাঠি। এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে গ্রামীণ জনপদে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।”
জনমত ও প্রত্যাশা
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় সরকার আরও স্বাধীন ও জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে। তবে পৌরসভা বিলুপ্তির প্রস্তাব নিয়ে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। একজন স্থানীয় নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “পৌরসভা না থাকলে শহরাঞ্চলের উন্নয়ন কীভাবে হবে, সেটা স্পষ্ট নয়।” অপরদিকে, নারী সদস্যদের ক্ষমতায়নের প্রস্তাবকে অনেকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন।
সংবাদ মাধ্যম ও জনগণের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে বলা যায়, এই সুপারিশ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এখনো চলবে। সরকার এটি গ্রহণ করলে বাংলাদেশের স্থানীয় শাসন ব্যবস্থায় নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে। তবে বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য এখনো বড় প্রশ্ন হিসেবে রয়ে গেছে।