বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী তিস্তা, যার উপর নির্ভর করে লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করায় নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে, যার ফলে কৃষি, পরিবেশ ও স্থানীয় জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এই পরিস্থিতির প্রতিবাদে তিস্তা পাড়ের মানুষ নদীতে নেমে ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন।
প্রথম আলো-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিস্তা নদী সংলগ্ন এলাকার হাজারো কৃষক নদীভাঙনের কারণে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে, ফলে তারা বিপাকে পড়ছেন। আবার বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ করে ভারত থেকে ছেড়ে দেওয়া অতিরিক্ত পানির ফলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়, যা ঘরবাড়ি, ফসল ও অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়।
তিস্তার পানির অভাবে কৃষকরা এখন বিকল্প পন্থায় সেচের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা অতিরিক্ত ব্যয়বহুল। অনেক চাষি তাদের জমিতে আবাদ করতে না পেরে অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছেন জীবিকার সন্ধানে। স্থানীয় কৃষক আব্দুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, “নদীর পানির অভাবে আমরা চরম বিপদের মুখে। চাষাবাদ করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে, অথচ সরকার এখনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।”
মহাপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্ক
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রতিবেদনে পরিবেশবিদ রিজওয়ানার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, তিস্তা পাড়ের মানুষের মতামতের ভিত্তিতেই মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হবে। কিন্তু বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রিতা এবং তহবিল সংস্থানের জটিলতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, “তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে স্থানীয়দের মতামতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের জীবন-জীবিকার ওপর প্রভাব না ফেলে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প সফল হতে পারে না।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলের চাপ সৃষ্টি করে ভারতের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে।
“তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়নই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ”
সমকাল-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ নেই। নদীর পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা না গেলে স্থানীয় কৃষি ও জীববৈচিত্র্য চরম ক্ষতির মুখে পড়বে।
একজন সরকারি প্রকৌশলী সমকালকে জানান, “এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তিস্তা পাড়ের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত হবে এবং নদীভাঙন ও পানির অভাবজনিত সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে। কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
আন্দোলন কীভাবে গড়ে উঠল?
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কয়েক বছর ধরে চললেও সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে তিস্তা পাড়ের মানুষ নদীতে নেমে প্রতীকী প্রতিবাদ জানান। এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি জানাচ্ছি। ভারত যদি আমাদের পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত না করে, তাহলে আমাদের জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “এটি শুধু আমাদের কৃষি বা জীবিকা সংক্রান্ত সমস্যা নয়, এটি একটি মানবিক সংকট। নদী শুকিয়ে গেলে এখানকার জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হয়ে যাবে।”
তিস্তা নদীর পানির সংকট সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞরা একাধিক প্রস্তাব দিয়েছেন। পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং পানি সম্পদ গবেষক ড. কামরুল আহসান বলেন, “তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। শুধুমাত্র আন্দোলন নয়, বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি উত্থাপন করাও জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের উচিত ভারত ও চীনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তিস্তা নদীর সমাধান খোঁজা। চীন ইতোমধ্যে এই অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে, তবে তা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমাধানের ওপর নির্ভর করছে।”
বাংলাদেশ সরকার তিস্তা নদীর পানি সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তি চূড়ান্ত করার চেষ্টা চলছে। তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আপত্তির কারণে এই চুক্তি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, “আমরা তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা চাই এবং এটি বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আমরা কূটনৈতিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করতে চাই।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও নদী অধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক সংস্থা তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছে।
বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ইতোমধ্যে তিস্তা নদী সংরক্ষণের জন্য অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছে, তবে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা ছাড়া এটি কার্যকর হবে না।
তিস্তা পাড়ের মানুষ চান, সরকার দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। স্থানীয় বাসিন্দা রহিমা খাতুন বলেন, “আমাদের এই সংকট থেকে মুক্তি দিতে হবে। সরকারকে ভারতের সঙ্গে শক্ত অবস্থানে গিয়ে আমাদের ন্যায্য পানির দাবি আদায় করতে হবে।”
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আন্দোলনকারীরা দাবি করছেন, ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করছে, যা আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টন চুক্তির লঙ্ঘন। তারা সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন, যেন তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা যায়।
এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশ সরকার কীভাবে এই সংকট সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করে এবং আন্তর্জাতিক মহল কিভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানায়। তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত না হলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।