ঢাকা, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) বাংলাদেশে বিগত সরকারের সময় ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে যে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা স্বাগত জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এই প্রতিবেদনকে বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ওএইচসিএইচআর স্বাধীনভাবে এই তদন্ত পরিচালনা করেছে এবং এতে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ব্যাপক দমন-পীড়ন চালিয়েছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ওই সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘তৎকালীন সরকার এবং তাদের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা, আওয়ামী লীগ ও এর সহিংস গোষ্ঠী সমন্বিতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল। এতে কয়েকশ নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে এবং হাজার হাজার বিক্ষোভকারী গুরুতর শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এছাড়া, ব্যাপকহারে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক, নির্যাতন এবং অন্যান্য নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।’
ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ওই সময়ের বিক্ষোভে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহৃত প্রাণঘাতী মেটাল প্যালেট লোড করা শটগানের আঘাতে নিহত হন। আহতদের মধ্যে অনেকেই স্থায়ীভাবে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। এছাড়া, পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ১১,৭০০ জনের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, যার মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘বিশেষ করে, আন্দোলনের প্রথমদিকে নারীরা ব্যাপকভাবে সহিংসতার শিকার হন। নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের যৌথ আক্রমণে অনেক নারী লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও ধর্ষণের হুমকির শিকার হন।’
ওএইচসিএইচআর জানিয়েছে, বিভিন্ন নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের একটি বড় অংশ পুলিশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় করে আন্দোলন দমনে কাজ করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পুলিশের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বিক্ষোভকারীদের দমন করতে সহিংসভাবে অংশ নিয়েছে।
এছাড়া, পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ৯৫ জনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে যারা বিক্ষোভ দমন অভিযানে সরাসরি অস্ত্র সরবরাহ এবং হামলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন সংসদ সদস্য, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা এবং পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৮ জুলাই এক বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে আরও কঠোর দমন-পীড়নের নির্দেশ দেন। পরদিন এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন বিক্ষোভকারীদের হত্যার জন্য এবং আন্দোলনের নেতাদের নিঃশেষ করতে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনের প্রকাশের পর অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) এবং নিয়মিত আদালতে তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। তবে, সরকারের প্রচেষ্টাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগের কাঠামোগত সমস্যার কারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দীর্ঘদিন ধরে পুলিশি অসদাচরণ এবং বিচার বিভাগের সীমাবদ্ধতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ কারণে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে।’
জাতিসংঘের প্রতিবেদনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশকে এমন একটি দেশে রূপান্তরিত করতে চাই যেখানে সকল নাগরিক নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে। আমরা ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিচার বিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগের সদস্যদের প্রতি আমার আহ্বান, আপনারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করুন, যারা আইন লঙ্ঘন করেছে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনুন এবং বাংলাদেশের জনগণের অধিকার রক্ষায় কাজ করুন।’
প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য অন্তর্বর্তী সরকারের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রকাশিত হয়েছে। ফেসবুক পোস্টে আরও বলা হয়েছে, ‘এই প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।’
অন্তর্বর্তী সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছে, তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে।