আজকের পত্র-পত্রিকার প্রধান শিরোনাম
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে মুখোমুখি ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধীরা এমন একটি খবর প্রকাশ করেছেন আজকের পত্রিকা তাদের প্রধান শিরোনামে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল
আজকের পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। এরপর ৫ বছর ধরে কোনো নির্বাচন নেই। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসনের পতনের পর ডাকসু নির্বাচনের দাবি উঠেছে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে ছাত্রশিবির, বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোও দ্রুত সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন চায়। তবে বাদ সেধেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এ নিয়ে ছাত্রদলের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেছেস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে সিন্ডিকেট সভায় ডাকসু নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত যেন না হয়, সেই দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় লিপ্ত হন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। পরে রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে ‘বাগ্বিতণ্ডা’ ও ‘ডাকসু নিয়ে টালবাহানা’ করার অভিযোগ এনে ক্যাম্পাসে মিছিল করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের, মাহিন সরকার, তাহমিদ আল মুদ্দাসসির চৌধুরী, অ্যাকটিভিস্ট মুসাদ্দিক আলী ইবনে মুহাম্মদ, এ বি জোবায়েরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। মিছিল শেষে তাঁরা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডাকসুর রোডম্যাপ ঘোষণা করার দাবি জানান।
তবে ছাত্রদলের একাধিক নেতা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শিবিরের নেতা-কর্মীরা শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে মব সৃষ্টি ও মিছিল করেছে।’ ছাত্রদলের নেতাদের অভিযোগ সত্য নয় বলে জানিয়েছেন শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্রশিবিরের কোনো সাংগঠনিক মিছিল ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ডাকসুর দাবিতে মিছিল করেছেন। সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি।’ ফরহাদ আরও বলেন, ‘ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ডাকসুর নীতিমালা সংস্কারসহ বিভিন্ন প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোও দিয়েছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ফেব্রুয়ারির মধ্যে ডাকসু নির্বাচন দেওয়া হোক।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্ল্যাটফর্ম আছে, কর্মচারীদের আছে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলার মতো কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের পাঁচটি হল; কিন্তু শিক্ষার্থী বেশি। তারা অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সে জায়গায় শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি, ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করা।’
আব্দুল কাদের আরও বলেন, এখন যখন ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কথা বলা হচ্ছে, যারা শিক্ষার্থীদের দাসত্বের জীবনে ফিরিয়ে নিতে চায়, হলে হলে গণরুম-গেস্টরুম কালচার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, তাদের ডাকসু নির্বাচনের খবরে গায়ে জ্বালা দিয়ে ওঠে। তারা শিক্ষককে
হেনস্তা করে, প্রশাসনকে হেনস্তা করে। ডাকসু নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে কাজ শুরু করেছে, তার সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসে মিছিলে যোগ দেওয়া তাহমিদ আল মুদ্দাসসির চৌধুরী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কের পাশাপাশি একতার বাংলাদেশ নামক একটি প্ল্যাটফর্মের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধি নেই, সে হিসেবে আমাদের দাবি—প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন দিয়ে দেওয়া। কারণ, শিক্ষার্থীরা এখন কোনো দাবি নিয়ে গেলে, সেটাকে মব বলা হচ্ছে। আমরা সেটা চাই না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান সিন্ডিকেট বহাল রেখে কোনো নির্বাচন নয়, এ রকম কথা ছাত্রদলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। আসলে এ রকম বক্তব্যের কোনো ফিজিবিলিটি নেই। এখন আবার নির্বাচন করে সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নেওয়া হলে, সেখানে আওয়ামীপন্থীরা জিতবে। আওয়ামী দোসরদের দূরে রেখে, শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী দ্রুততম সময়ে ডাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করার দাবি করছি।’
অ্যাকটিভিস্ট মুসাদ্দিক আলী ইবনে মুহাম্মদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের চক্রান্ত লক্ষ করা যাচ্ছে। ছাত্রদল প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ডাকসু নির্বাচনের বিরোধিতা করে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করার। ডাকসুর গঠনতন্ত্রের যে সংস্কার প্রয়োজন, তাও রোডম্যাপের মধ্যে চলে আসে সাধারণত। এ অবস্থায় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যদি ডাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা না হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা কঠোর কর্মসূচির দিকে যেতে বাধ্য হবে।
ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধন ও অগণতান্ত্রিক ধারাগুলো বাতিল করে দ্রুততম সময়ে ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানায় বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো। গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সংগঠক সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ডাকসু বন্ধ থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক ভিতের ওপর দাঁড় করানোর আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়েছে। এর অংশ হিসেবেই অবিলম্বে ডাকসু নির্বাচন চালু করতে হবে। ডাকসু নির্বাচনের আগে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সব ছাত্রসংগঠন সমানভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারে। নির্বাচনের আগে ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে হবে এবং অগণতান্ত্রিক ধারাগুলো বাতিল করতে হবে।
ছাত্রদলের ৪ নেতাকে শোকজ
এদিকে গতকাল উপাচার্যের সঙ্গে বাল্বিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে ছাত্রদলের ৪ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশ পাওয়া নেতারা হলেন হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল শাখার প্রচার সম্পাদক মনসুর আহমেদ রাফি, বিজয় একাত্তর হল শাখার দপ্তর সম্পাদক সাকিব বিশ্বাস, মাস্টারদা সূর্য সেন হল শাখার সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক মো. আবিদুর রহমান মিশু, বিজয় একাত্তর হল ছাত্রদলের সহদপ্তর সম্পাদক সুলতান মো. সালমান সিদ্দিক।
এ ঘটনায় ছাত্রদলের বিরুদ্ধে একটি দল অপপ্রচার করে ইমেজ ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনের। তিনি বলেন, ‘ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনকে নিজেদের প্রাণের দাবি হিসেবে বিবেচনা করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনায় বারবার ডাকসু সংস্কার ও নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এসেছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কারের বিষয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোসহ সব অংশীদারের প্রস্তাবনা আহ্বান করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমে ডাকসুর উপযুক্ত সংস্কার ও নিয়মিত নির্বাচন চালু করার জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতার মনোভাব পোষণ করছে। তারপরও ছাত্রদলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে ইমেজ ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে।
সিন্ডিকেট সভায় ডাকসু নিয়ে আলোচনার বিরোধিতা ছাত্রদলের।
‘টালবাহানা’ করার অভিযোগ এনে মিছিল বৈষম্যবিরোধীদের।
উপাচার্যের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় ছাত্রদলের ৪ নেতাকে শোকজ।
তদন্তের জন্য পুলিশের বাইরে সংস্থার প্রস্তাব
কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদন
ফৌজদারি মামলার তদন্ত করে পুলিশ। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন মনে করে, তদন্তে আলাদা সংস্থা দরকার।
মহিউদ্দিন ফারুক, ঢাকা
ফৌজদারি অপরাধের মামলা তদন্তের জন্য আলাদা সংস্থা গঠন করা প্রয়োজন বলে মনে করে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। সংস্থাটি হবে দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য, যাতে প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে। একই সঙ্গে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছে কমিশন।
কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে এসব প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
বর্তমানে ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করে পুলিশ। থানা-পুলিশের পাশাপাশি অপরাধ তদন্তে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রয়েছে। এর মধ্যে পিবিআই যাত্রা শুরু করে ২০১২ সালে। তবে এসব ইউনিট পুলিশের অধীনে পরিচালিত হয়। নিয়োগ হয় পুলিশ থেকে বদলির মাধ্যমে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন যে তদন্ত সংস্থার কথা বলছে, তার কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রাথমিক প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, সংস্থাটির জনবল পুলিশ বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। তাদের নিয়োগ, চাকরির শর্ত, বাজেট, অবকাঠামো ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি একটি স্বতন্ত্র সংগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোভুক্ত হবে। সাধারণভাবে প্রস্তাবিত সংস্থা কাজ শুরু করবে মামলা দায়েরের পর। এই সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট অ্যাটর্নি বা প্রসিকিউটরের তদারকিতে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য আইনজীবী তানিম হোসেইন শাওন প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক প্রতিবেদনে সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় যথাযথ ও প্রভাবমুক্ত তদন্ত
তদন্তের জন্য পুলিশের বাইরে সংস্থার প্রস্তাব
নিশ্চিতে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠন; স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা এবং স্বল্প ব্যয়ে ও স্বল্প সময়ে কার্যকর বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে। এগুলোর পাশাপাশি বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা, পর্যাপ্ত বাজেট নিশ্চিত করাসহ বেশ কয়েকটি বিষয় কমিশনের বিবেচনায় রয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসবের প্রতিফলন থাকবে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশ পেতে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি কমিশন গঠন করেছে, যার একটি বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের এই কমিশন গঠন করা হয় গত ৩ অক্টোবর। ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। সময়সীমা গতকাল শুক্রবার শেষ হয়। তবে সময়সীমা ইতিমধ্যে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কমিশন এর আগে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় তদন্ত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তদন্ত কর্মকর্তা সৎ, সাহসী, দক্ষ ও পেশাদার না হলে তদন্ত প্রতিবেদনে নানা রকম দুর্বলতা থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা কারণে যথাযথভাবে প্রকৃত তথ্য প্রতিফলিত হয় না। দ্রুত ও মানসম্পন্ন তদন্তের ওপর মামলার ফলাফল অনেকাংশে নির্ভরশীল।
কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোটা পৃথিবীতে পুলিশ ফৌজদারি মামলার তদন্ত করে। তবে ফ্রান্সে ম্যাজিস্ট্রেটদের তদন্তের উদাহরণ আছে। আমরা তদন্তের জন্য সিআইডি, পিবিআই ও দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) মতো সংস্থা করেছি। এরপরও কেন নতুন তদন্ত সংস্থার প্রয়োজন হবে, সেটি পরিষ্কার নয়।’ তিনি বলেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তার তদন্তে আইজিপিরও কিছু বলার ক্ষমতা নেই। এরপরও তো প্রভাব বিস্তারের ঘটনা ঘটেছে। এগুলো হয়েছে মূলত রাজনৈতিক কারণে। নতুন সংস্থা হলে যে সেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে।
আইনজীবীরা বলছেন, দেশে সার্বিকভাবে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তদের দোষী প্রমাণিত হওয়ার হার কম-বেশি ২০ শতাংশ। ৮০ শতাংশই খালাস পেয়ে যায়। এর কারণ, তদন্তে ঘাটতি। থানা-পুলিশের একেকজন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে অনেক মামলা থাকে। তাঁদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নানা কাজ থাকে। ফলে সব মামলার তদন্তে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারেন না তদন্ত কর্মকর্তা। অনেকের বিরুদ্ধে প্রভাবশালীর চাপে তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়া এবং ঘুষ গ্রহণের অভিযোগও রয়েছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত মাসে ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানায়, দেশে সর্বোচ্চ ঘুষ গ্রহণকারী পাঁচটি খাত হলো পাসপোর্ট, বিআরটিএ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা ও ভূমি খাত।
মিথ্যা মামলা ও হেনস্তা
সংস্কার কমিশন বলেছে, একটি বড় সমস্যা হলো মিথ্যা মামলা। অনেক ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিদের সঙ্গে নির্দোষ ব্যক্তিদেরও মামলায় যুক্ত করা হয়। আবার প্রকৃত ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করা হয় বা মূল ঘটনাকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধামাচাপা দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে তদন্ত সুষ্ঠু না হলে নিরপরাধ ব্যক্তির হয়রানির আশঙ্কা থাকে বা প্রকৃত অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়। বিরোধী পক্ষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা দায়ের ও পুলিশকে ব্যবহারের মাধ্যমে হেনস্তার ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে।
সংস্কার কমিশন বলছে, পুলিশের কিছু সদস্যের দুর্নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও অসৎ উদ্দেশ্যে পুলিশকে যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশের ব্যাপারে একধরনের ভীতি কাজ করে। এ ছাড়া তদন্তকাজ পরিচালনায় পুলিশের কোনো একক ইউনিট নেই; বরং একাধিক বিভাগকে একই ধরনের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পুলিশের তদন্ত ব্যবস্থা যথেষ্ট সুসংগঠিত ও সুদক্ষ নয়। সমন্বয়ের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই আদালতে মামলার বিচার শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়।
সংস্কার কমিশন মনে করে, স্বতন্ত্র, কার্যকর, দক্ষ, নির্ভরযোগ্য, জনবান্ধব এবং প্রভাবমুক্ত তদন্ত সংস্থা গঠন করা প্রয়োজন।
অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব
প্রাথমিক প্রতিবেদনে অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের প্রস্তাবের পক্ষে তথ্য ও যুক্তি তুলে ধরেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ভাষ্য, এ পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেলসহ সর্বস্তরের আইন কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়েছেন মূলত অস্থায়ীভাবে এবং রাজনৈতিক বিবেচনায়। আইন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন বিষয়ে জবাবদিহির কোনো আইনি কাঠামো নেই। যোগ্যতা বা দক্ষতা বা সততা নয়, মূলত আইন কর্মকর্তাদের নিয়োগকে বিবেচনা করা হয় রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে।
এ ছাড়া অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ছাড়া জেলা পর্যায়ে কোনো আইন কর্মকর্তার জন্য পৃথক অবকাঠামো, সহায়ক জনবল, বাজেট বা আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। ফৌজদারি মামলার তদন্তকারী ব্যক্তি অথবা সংস্থার সঙ্গে আইন কর্মকর্তাদের মতামত গ্রহণ বা গুরুত্ব দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও নেই। জেলা পর্যায়ের আইন কর্মকর্তার জন্য নির্ধারিত পারিশ্রমিক অতি নগণ্য। তাঁদের দায়িত্ব পালনের মান মোটেও সন্তোষজনক নয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন বলে কমিশন মনে করে।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে প্রস্তাবিত অ্যাটর্নি সার্ভিসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। এর ভাষ্য, অ্যাটর্নি সার্ভিস হবে একটি স্থায়ী সরকারি চাকরি। সার্ভিসের সুনির্দিষ্ট কাঠামো, নিয়োগপদ্ধতি, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা, বেতনকাঠামোসহ আর্থিক সুবিধাদি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে যথাযথ বিধানসংবলিত আইন থাকবে। পর্যাপ্ত অবকাঠামো, বাজেট বরাদ্দ ও সহায়ক জনবলের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রস্তাবিত সার্ভিসের দুটি ইউনিট থাকবে— (ক) অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্ট ইউনিট এবং (খ) অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট এবং ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি সমন্বয়ে গঠিত জেলা ইউনিট।
ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা এবং স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক। সংস্কার কমিশনের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যতিক্রম, যেখানে ল ক্যাডার সার্ভিস নেই। ক্ষমতাসীন দল বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে শুরু করে আইন কর্মকর্তা ও পিপি-এপিপি পদে রদবদল হয়ে যায়। নতুন ক্ষমতাসীন দলের অনুসারীরা ওই সব পদে নিয়োগ পান। এতে দক্ষতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি দেখা যায়।
শাহদীন মালিক বলেন, পুলিশকে বহু ধরনের কাজ করতে হয়। যদি আলাদা করে একদল শুধু তদন্তের জন্য নিয়োজিত থাকে, তাহলে তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বাড়বে। তদন্ত সঠিক ও যথার্থ হবে।
শীতকালীন ডায়রিয়া বাড়ছে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতার খবর এটি , খবরে বলা হয়

রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ৮৫০ শিশু চিকিত্সা নিচ্ছে আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে
মোর্শেদা ইয়াসমিন পিউ
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১৩ মাস বয়সী নুসাইবা ইসলাম। বাবা আরিফ ইসলাম ও মা আমিনা ইসলাম তাদের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে এসেছেন রাজধানীর মহাখালী আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (আইসিডিডিআর,বি)। হাসপাতালের নীচতলার এফ-ব্লকে বিছানায় কথা হয় তাদের সঙ্গে। জানা যায়, কুমিল্লার বড়ুয়া এলাকার আদ্রা গ্রাম থেকে এসেছেন তারা। আরিফ ইসলাম বলেন, মেয়ের অল্প জ্বর, বমি আর পাতলা পায়খানা ছিল গত তিনদিন ধরে, তাই ডাক্তার দেখাতেই ঢাকায় আসা। বৃহস্পতিবার ডাক্তারের চেম্বারেই নুসাইবার অনেক বেশি পাতলা পায়খানা শুরু হয় এবং বাচ্চা দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন দ্রুত মেয়েকে নিয়ে বিকেলে আইসিডিডিআর,বিতে আসি। চিকিত্সক মেয়েকে দেখে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নেন।
১৪ মাস বয়সি শিশু ইবাদতকে নিয়ে মা শ্যামলী বেগম এসেছেন ওই হাসপাতালে। বি-ব্লকে কথা হয় তার সঙ্গে। মাদারীপুরের শিবচর থেকে এসেছন তারা। বললেন, ‘আমাদের এলাকায় ডাক্তার দেখিয়েছি, বাচ্চার হাতে স্যালাইন দিতে রগ খুঁজে পায় না, আমার বাচ্চার চারদিনে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিল, তাই ঢাকায় নিয়ে আসছি।’
শীতকালীন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ইবাদত, নুসাইবার মতো অসংখ্য শিশু প্রতিদিন আসছে হাসপাতালে। রাজধানীর মহাখালীর আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালেই গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ৮০০ শিশু চিকিত্সা নিচ্ছে। যাদের ৮০ শতাংশ দুই বছরের কম বয়সি শিশু। প্রতিবছর শীতের সময়েটাতে এই রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। তবে এ বছর কিছুটা বেশি বলে জানান চিকিত্করা। তবে সাধারণ ডায়রিয়ায় এখন আর শিশুর মৃত্যু হয় না। সচেতন থাকতে হবে, তবে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই বলে জানান তারা।
আইসিডিডিআর,বির ঢাকা হাসপাতালের এসএসইউ ওয়ার্ডের ক্লিনিক্যাল লিড ডা. শোয়েব বিন ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, প্রতিবছর শীতের শুরুতে আমাদের এখানে ডায়রিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। যদিও বিগত দুই বছরের তুলনায় এবছর কিছুটা বেশি। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ২০ থেকে ২৫ ভাগ বেশি রোগী দেখা যাচ্ছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রায় সব এলাকা থেকেই শিশুরা ডায়রিয়া নিয়ে আসছে এই হাসপাতালে। ঢাকার আশপাশ এলাকা থেকেও রোগী আসছে। যেহেতু শীতের সময় এটা হয়। আমরা মাইক্রবাইলোজিক্যাল অ্যাসেস করি, আসলে কোন ভাইরাস দিয়ে এটা হচ্ছে। দেখো যাচ্ছে—রোটা ভাইরাস দিয়ে এই ডায়রিয়াটা হচ্ছে।
ডায়রিয়া অনেক কারণে হয় তারমধ্যে রোটা ভাইরাস একটা কারণ। এই ডায়রিয়ার লক্ষণ হচ্ছে— শিশুর অল্প জ্বর থাকে, আবার অনেক সময় জ্বর থাকেও না, পানির মতো পাতলা পায়খানা হয়। কোন ক্ষেত্রে সাদা পায়খানা হয়, কোনটা আবার হলুদ রঙের পায়খানা হয়। এই ডায়রিয়াতে রক্ত যায় না, শুরুতে জ্বর থাকলেও তা চলে যায়। এই ডায়রিয়া ভালো হতে ৫ থেকে ৭ দিন সময় লাগে। ভাইরাল এই ডায়রিয়ায় আমরা এন্টিবায়টিক ব্যবহার করি না বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ।
ডায়রিয়া হলে মায়েদের করণীয়: ডায়রিয়া হলে মায়েদের আতঙ্কিত না হওয়ার কথা বলেন ডা. শোয়েব। তিনি বলেন, শীতকালে বাচ্চাদের ডায়রিয়া হয়ে থাকে। এই সময়ে সচেতন থাকতে হবে এবং কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। প্রথম হলো— পাতলা পায়খানা হলে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পরে আপনার বাচ্চার ওজন যত কেজি, তত চামচ স্যালাইন পানি খাওয়ান। ৫ এমএল এর চামচে মেপে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। ডায়রিয়া চলাকালে শিশুকে ধীরে ধীরে স্যালাইন খাওয়াতে হবে; তাহলে শিশু বমি করবে না। এছাড়া আমরা জিঙ্ক ট্যাবলেট খাওয়াতে বলি। আর এসময় শিশু স্বাভাবিক খাবারই খাবে। মায়ের বুকের দুধ কোনভাবেই বন্ধ করা যাবে না। এভাবে ৫-৭ দিনে শিশু সুস্থ হয়ে ওঠে, তবে অল্প কিছু শিশুর ক্ষেত্রে ৮ থেকে ১০ দিন সময় লাগে সুস্থ হতে। স্যালাইন গুলানোর ১২ ঘন্টা পরে তা আর খাওয়া যাবে না।
কখন চিকিত্সকের শরণাপন্ন হতে হবে: যদি দেখা যায় বাচ্চা দুর্বল হয়ে নেতিয়ে পড়েছে। বাচ্চা খেতে পারছে না, কিংবা শিশুর পানিশূন্যতা দেখা দিচ্ছে, বাচ্চার তীব্র জ্বর, পায়খানায় রক্ত আসছে বা বাচ্চার খিচুনি আসছে—তখন শিশুকে দ্রুত চিকিত্সকের কাছে নিতে হবে।
স্যালাইন বানাতে হবে সঠিকভাবে: স্যালাইন একটা ঔষধ, এটা কোন সাধারণ খাবার না। অল্প পানিতে, অল্প স্যালাইন গুলিয়ে অথবা ভালোভাবে না গুলিয়ে স্যালাইন খাওয়া যাবে না। ডা. শোয়েব বলেন, স্যালাইন বানাতে হবে সঠিকভাবে। স্যালাইন ও পানির অনুপাত ঠিক না হলে শিশুদের শরীরে লবণের পরিমাণ বেড়ে যায়। এসময় বাচ্চাদের আরো পানির পিপাসা বেড়ে যায়। সে আরো পানি খেতে চায় এবং ওই স্যালাইন পানি খাওয়ার ফলে শরীরে আরো লবণ বেড়ে যায়। একটা সময় বাচ্চার খিচুনি হয়। এ ধরনের সমস্যায় আমরা অনেক সময় বাচ্চাকে বাঁচাতে পারি না।
করুণ দশা স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশ প্রতিদিনের শিরনাম এটি,
জয়শ্রী ভাদুড়ীর লেখা এই প্রতিবেদনে বলা হয় ,
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন ফয়েজ উদ্দিন (৫৫)। ব্রেন টিউমার নিয়ে আগারগাঁওয়ের নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাঁর ছেলে
শিহাব উদ্দিন (৩১)। ফয়েজ উদ্দিন বলেন, ‘ছেলের ব্রেন টিউমারসহ আরও বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে। অপারেশন, ওষুধপথ্য সব মিলিয়ে প্রায় ৫ লাখ টাকার প্রয়োজন। এর আগে ডাক্তার দেখানো, টেস্ট করাতে সঞ্চয়ের ২ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। আমার বেতনে সংসার চালানোই কঠিন। তাই ছেলেকে বাঁচাতে ৩ লাখ টাকা ঋণ করেছি। জানি না আমি এ ঋণের টাকা কীভাবে শোধ করব।’ শুধু ফয়েজ উদ্দিনই নন, এ রকম চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে ঋণের বোঝা বাড়ছে লাখো মানুষের। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের ৬১ লাখ মানুষ প্রতি বছর দারিদ্র্যসীমার নিচে নামছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ওষুধের পেছনে। ক্যান্সার, হৃদরোগ, লিভার ও কিডনির চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত হচ্ছেন রোগী। কাটছে না দেশের চিকিৎসায় আস্থার সংকট। দেশের সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, সংকট, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা প্রকট। বেসরকারিতে রয়েছে আস্থার সংকট, প্রতারণার ফাঁদ। এসব কারণে সামর্থ্যবানরা ছুটছেন ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর। দেশের জেলা শহর থেকে হৃদরোগ, স্ট্রোকের জরুরি রোগী নিয়ে ছুটতে হয় ঢাকাতে। ঢাকার বাইরে গড়ে ওঠেনি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা। স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির নামে সরকারি বরাদ্দ ও দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হলেও লুটপাট নয়ছয়ে পরিবর্তন আসেনি স্বাস্থ্যব্যবস্থায়। বেসরকারি হাসপাতালে টেস্টের দাম নির্ধারণ না হওয়ায় গলা কাটা দাম রাখা হয় রোগীর কাছে থেকে। হাসপাতালের ক্যাটাগরি নির্ধারণ করে মূল্যতালিকা নির্দিষ্ট না করায় অপারেশনের খরচ, শয্যা ভাড়া যে যার ইচ্ছামতো আদায় করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, জেলা বা জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ বিভিন্ন হাসপাতাল রয়েছে মোট ৭৫০টি। এর বাইরেও সরকারের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট শয্যাসংখ্যা ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি। এর মধ্যে বেসরকারিতেই রয়েছে প্রায় ৯৫ হাজার শয্যা। আর বেসরকারি রোগ নিরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে প্রায় ১০ হাজার ও ব্লাড ব্যাংক ১৮০টি।
গবেষকেরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিমা ছাড়া দেশের চিকিৎসা ব্যয় কমানো অসম্ভব। যত দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে রোগের প্রকোপ, বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়ও। চিকিৎসা ব্যয় বিষয়ে সবশেষ পরিস্থিতি জানতে ১৪ হাজারের বেশি রোগী ও পরিবারের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে সরকারের উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। গত জুলাইতে ‘বাংলাদেশে বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয়ের ধাক্কা ও দারিদ্র্য : ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য’ উপস্থাপন করে বিআইডিএস। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এই স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। অর্থাৎ তখন দেশে যত দরিদ্র মানুষ ছিলেন, তার মধ্যে ২০ শতাংশ দরিদ্র হয়েছে এই স্বাস্থ্যগত কারণে।
এর মূল কারণ চিকিৎসা বাবদ মানুষের ব্যয় বেড়ে যাওয়া। ১৯৯৭ সালে যা ছিল ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০২০ সালে ছিল ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালে তা ৭৩ শতাংশে উঠে যায়। গ্লোবাল হেলথ এক্সপেনডিচার ডেটাবেস সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে ব্যক্তি মানুষের চিকিৎসা বাবদ যত ব্যয় হয়, তার ৭৩ শতাংশ ব্যক্তিকে বহন করতে হয় অর্থাৎ সরকার বহন করছে মাত্র ২৭ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে কেবল আফগানিস্তানে এই ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি, যেখানে প্রতি ১০০ টাকা স্বাস্থ্য ব্যয়ের মধ্যে ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় ৭৭ দশমিক ২ শতাংশ।
বিআইডিএস স্বাস্থ্য অর্থনীতি গবেষক ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া রোগীদের মাসিক ব্যয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। সবচেয়ে বেশি মাসে গড়ে ১৯ হাজার টাকা ব্যয় হয় ক্যান্সার রোগীর। আর হৃদরোগের পেছনে ব্যয় হয় আট হাজারের বেশি। মূলত ওষুধ কিনতেই পকেট খালি হয় রোগীর। মোট চিকিৎসা ব্যয়ের অর্ধেকের বেশিই যায় ওষুধের পেছনে। এর পরই রয়েছে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসকের ফি।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন রোগীকে চিকিৎসা নিতে নিজ পকেট থেকে ব্যয় করতে হচ্ছে ৬৮ দশমিক ৫০ ভাগ টাকা। রোগীকে সবচেয়ে বেশি ৬৪ ভাগ টাকা ব্যয় করতে হয় ওষুধ খাতে। এরপর হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোরে সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে ২৩ ভাগ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যয় হয় ৮ ভাগ অর্থ। নিজ পকেট থেকে ব্যয় বাড়ার কারণে ১৬ দশমিক ৪ ভাগ রোগী প্রয়োজন থাকলেও চিকিৎসা নিতে পারে না। ২০১২ সালে রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় ছিল ৬৪ ভাগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আস্থার সংকট আছে। এখানে চিকিৎসার খরচ বেশি, চিকিৎসা নিতে গিয়ে দুর্ভোগের শিকার হতে হয় রোগীদের। চিকিৎসা সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। সরকারি হাসপাতালে কার্যকর সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালে সেবার দাম ও মান নির্ধারণ করে সেটা টাঙিয়ে রাখতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ক্যাটাগরি অনুযায়ী দাম ঠিক করে দিতে হবে। রোগী তার সামর্থ্য অনুযায়ী সেবা নিতে পারবে। ডায়াগনস্টিকেও দাম নির্ধারণ করে মান নিশ্চিত করতে হবে। প্রেসক্রিপশন অডিট চালু করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে ডায়াগনস্টিক সেবা জোরদার করতে হবে। চিকিৎসায় রেফারেল পদ্ধতি চালু করতে হবে। হাসপাতাল থেকে দালাল ও বিদেশি এজেন্টদের উচ্ছেদ করতে হবে।’