রমজান মাস মুসলমানদের জন্য আত্মশুদ্ধি ও সংযমের মাস। এ মাসে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য, পানীয় এবং যৌন সম্পর্ক থেকে বিরত থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে। তাই রোজা রেখে দিনের বেলা স্বামী-স্ত্রীর সহবাস করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ এবং এটি ইসলামী বিধান অনুযায়ী গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
রোজা রেখে সহবাস করলে কী হবে?
ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী, যদি কেউ দিনের বেলায় রোজা রেখে সহবাস করে, তাহলে তার রোজা ভেঙে যাবে এবং তাকে কাফফারা আদায় করতে হবে। কাফফারা হলো এমন শাস্তি, যা এই গুনাহের জন্য নির্ধারিত। কাফফারা হিসেবে দুটি প্রধান বিকল্প রয়েছে:
একাধারে ৬০ দিন রোজা রাখা – যদি কেউ বিনা বিরতিতে ৬০ দিন রোজা রাখতে পারে, তবে তার কাফফারা পূর্ণ হবে।
৬০ জন দরিদ্রকে খাওয়ানো – যদি ৬০ দিন রোজা রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে তাকে ৬০ জন দরিদ্রকে খাওয়াতে হবে।
এছাড়াও, রোজা ভঙ্গের কারণে ঐ দিনের রোজা কাযা করতে হবে, অর্থাৎ পরে একদিন রোজা রাখতে হবে।
কোন কোন কারণে রোজা ভেঙে যায়?
ইসলামে রোজার কিছু ভঙ্গের কারণ রয়েছে, যা মেনে চলা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোজা ভঙ্গের কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:
ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বা পানীয় গ্রহণ করা: যদি কেউ ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেলে, তবে তার রোজা ভাঙবে না। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বা পানীয় গ্রহণ করলে রোজা বাতিল হয়ে যাবে।
স্বামী-স্ত্রীর সহবাস করা: দিনের বেলা সহবাস করলে রোজা ভেঙে যাবে এবং কাফফারা আদায় করতে হবে।
বীর্যপাত ঘটানো: ইচ্ছাকৃতভাবে বীর্যপাত ঘটালে (যেমন—হস্তমৈথুনের মাধ্যমে) রোজা ভেঙে যাবে।
ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা: যদি কেউ নিজের ইচ্ছায় বমি করে, তবে রোজা ভেঙে যাবে। তবে অসাবধানতাবশত বমি এলে রোজা ভাঙবে না।
ঋতুস্রাব বা প্রসব-পরবর্তী রক্তস্রাব: নারীদের মাসিক ঋতুস্রাব বা সন্তান জন্মের পরকারি রক্তস্রাব হলে রোজা ভেঙে যায়।
ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেললে রোজা ভাঙবে কি?
অনেক সময় ভুলে মানুষ কিছু খেয়ে ফেলে বা পান করে ফেলে। ইসলামী বিধান অনুসারে, ভুলবশত খেয়ে ফেললে রোজা ভাঙবে না। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন,
“যে ব্যক্তি রোজা অবস্থায় ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেলে বা পান করে ফেলে, সে যেন রোজা পূর্ণ করে। কারণ আল্লাহ তাকে খাইয়েছেন ও পান করিয়েছেন।” (বুখারি ও মুসলিম)
সারাদিন না খেয়ে থাকলেও রোজা হবে না যে কারণে
অনেকেই মনে করেন, সারাদিন না খেয়ে থাকলেই রোজা পালন হয়ে যায়। কিন্তু ইসলাম অনুসারে রোজার জন্য নিয়ত (অর্থাৎ রোজা রাখার মনোবাসনা) আবশ্যক। যদি কেউ নিয়ত না করে সারা দিন না খেয়ে থাকে, তবে তা রোজা হিসেবে গণ্য হবে না।
রাতের বেলায় সহবাস করা যাবে কি?
রমজান মাসে শুধুমাত্র দিনের বেলায় স্বামী-স্ত্রীর সহবাস নিষিদ্ধ। কিন্তু ইফতার করার পর থেকে সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত সহবাস করা জায়েজ। আল-কুরআনে বলা হয়েছে:
“তোমাদের জন্য রমজান মাসের রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা হালাল করা হলো। তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক।” (সূরা বাকারা: ১৮৭)
বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ যেমন তাফসিরে তাবারি, তাফসিরে ইবনে কাসির এবং অন্যান্য সূত্রের ভিত্তিতে সংকলিত:
এই আয়াতটি রমজান মাসে রোজা পালনের নিয়মাবলী বর্ণনার অংশ হিসেবে নাযিল হয়েছিল। ইসলামের প্রথম দিকে মুসলমানদের জন্য রোজার বিধান ছিল কঠোর। তারা সূর্যাস্তের পর খাওয়া-দাওয়া করলেও রাতে ঘুমিয়ে পড়লে বা ইশার নামাজের পর আর কিছু খাওয়া বা স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা নিষিদ্ধ মনে করতেন। এই কঠিন নিয়মের কারণে অনেকে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং কেউ কেউ ভুলবশত নিজেদের উপর এই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনও করেছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে এই আয়াত নাযিল হয়, যা রোজাদারদের জন্য সহজতা ও রহমত প্রদান করে।
“রাতে সহবাসের অনুমতি”
“তোমাদের জন্য রমজান মাসের রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা হালাল করা হলো” – এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, রোজার দিনে দিনের বেলা (ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত) সহবাস নিষিদ্ধ থাকলেও রাতে (সূর্যাস্ত থেকে ভোর পর্যন্ত) এটি বৈধ। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ অনুমতি ও রহমত।
“তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক”
এই উপমাটি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক, নৈকট্য এবং পারস্পরিক শান্তি-সমর্থনের ইঙ্গিত দেয়। যেমন পোশাক শরীরকে ঢেকে রাখে, সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং সুরক্ষা দেয়, তেমনি স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্য শান্তি, সম্মান ও সুরক্ষার উৎস। এটি বৈবাহিক সম্পর্কের পবিত্রতা ও গুরুত্ব তুলে ধরে।
“আল্লাহ জানেন যে, তোমরা নিজেদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছিলে”
এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি রয়েছে। আগের কঠিন নিয়মের কারণে কেউ কেউ ভুল করে রাতে সহবাসে লিপ্ত হয়েছিল বা নিজেদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছিল। আল্লাহ তাদের এই দুর্বলতা জানতেন এবং তাই এই সহজতা দান করেছেন।
“তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন এবং তোমাদেরকে মাফ করে দিয়েছেন”
এটি আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার প্রকাশ। যারা অজ্ঞতাবশত বা ভুলে আগে এই নিয়ম লঙ্ঘন করেছিলেন, তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে।
“এখন তোমরা তাদের সাথে সহবাস কর এবং আল্লাহ যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা অনুসন্ধান কর”
এখানে অনুমতির পাশাপাশি একটি সীমারেখাও টানা হয়েছে। রাতে সহবাস করা জায়েজ, তবে আল্লাহ যে সীমা নির্ধারণ করেছেন (যেমন, দিনে রোজা ভঙ্গ না করা) তা মেনে চলতে হবে। কেউ কেউ এখানে “অনুসন্ধান কর” বলতে সন্তান লাভের ইচ্ছাকেও বোঝান।
শিক্ষা ও তাৎপর্য
ইসলামে সহজতা: এই আয়াত ইসলামের একটি মূলনীতি প্রকাশ করে, যে ধর্ম মানুষের জন্য অযথা কষ্ট আরোপ করে না, বরং স্বাভাবিক চাহিদা পূরণের জন্য সুযোগ দেয়।
বৈবাহিক সম্পর্কের গুরুত্ব: স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে একটি পবিত্র ও সম্মানজনক বন্ধন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আল্লাহর রহমত: এটি আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
তবে, ফজরের সময়ের আগে অবশ্যই গোসল করে পাক-পবিত্র হতে হবে, যাতে সুবহে সাদিকের পর রোজা রাখা যায়।
যৌন চাহিদা দমন করার কিছু উপায়
যেহেতু রমজানে দিনের বেলায় সহবাস করা নিষিদ্ধ, তাই রোজাদারদের জন্য সংযম বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যৌন চাহিদা নিয়ন্ত্রণের কিছু উপায় হলো:
সৃষ্টি কর্তার স্মরণ করা: কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও ইবাদতে মনোযোগী হওয়া।
কামুক চিন্তা এড়িয়ে চলা: এমন বিষয় এড়িয়ে চলা যা যৌন উদ্দীপনা তৈরি করতে পারে।
সুস্থ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা: এমন খাবার গ্রহণ করা, যা শরীর ও মনকে শান্ত রাখে।
শরীরচর্চা করা: হালকা ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করলে মনের মধ্যে স্বাভাবিক প্রশান্তি আসতে পারে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো: অতিরিক্ত জাগরণ যৌন উত্তেজনা বাড়িয়ে দিতে পারে, তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানো উচিত।
রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
রমজান মাসের রোজা রাখা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। রোজা রাখার মাধ্যমে মানুষ আত্মসংযম ও তাকওয়া অর্জন করে। রোজার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো:
আত্মশুদ্ধি: রোজা মানুষকে খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে সাহায্য করে।
ধৈর্য ও সংযম চর্চা: ক্ষুধা ও পিপাসা সহ্য করার মাধ্যমে ধৈর্য বাড়ে।
সমাজের দরিদ্রদের প্রতি সহমর্মিতা: ক্ষুধার্ত থাকার অভিজ্ঞতা দরিদ্র মানুষের কষ্ট বোঝার সুযোগ দেয়।
আল্লাহর নৈকট্য লাভ: রোজার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর আরও কাছাকাছি যেতে পারে।
স্বাস্থ্য উপকারিতা: বিজ্ঞানীরা বলেন, রোজা শরীরের জন্য উপকারী, এটি শরীরের টক্সিন দূর করে এবং হজম শক্তি বাড়ায়।
রোজা রাখা মানেই কেবল না খেয়ে থাকা নয়, বরং এটি একটি সার্বিক সংযমের শিক্ষা দেয়। দিনের বেলায় সহবাস করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং এটি করলে রোজা ভেঙে যায়। তবে রাতে সহবাস করার অনুমতি আছে। যারা রোজা রেখে নিজেদের যৌন চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে চান, তাদের উচিত আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা এবং আত্মসংযম চর্চা করা। রমজান মাসে এই বিধান মেনে চলা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ, এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব।