দ্বিকক্ষ সংসদ: ক্ষমতার ভারসাম্য আনার নতুন দিগন্ত
রিয়াদুল করিমের প্রথম আলোতে লেখা প্রতিবেদনে বলা হয় , জাতীয় সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার সুপারিশসহ একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব আনতে যাচ্ছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। দেশে বিদ্যমান এককক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পরিবর্তে প্রস্তাবিত কাঠামোতে দুটি কক্ষ থাকবে—নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, নিম্নকক্ষে ৪০০ আসন থাকবে, যার মধ্যে ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। নিম্নকক্ষর আসনগুলোতে সরাসরি ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অপরদিকে, উচ্চকক্ষে ১০৫টি আসন থাকবে। ১০০টি এর মধ্যে আসনে নির্বাচন হবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে এবং বাকি পাঁচটি আসনে রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন দেবেন। এই নতুন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে মোট সংসদ সদস্য সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০৫।
ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে সংবিধান সংস্কার কমিশনের উদ্যোগ
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, একনায়কতন্ত্র ঠেকাতে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে এই প্রস্তাব আনা হচ্ছে। বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোয় এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে কমিশন জানিয়েছে। কমিশন তাই ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দিচ্ছে। প্রস্তাবিত কাঠামোয় একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কতবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের দায়িত্ব আলাদা আলাদা করার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সংসদের নতুন কাঠামোতে কি কি আছে ?
নিম্নকক্ষের নির্বাচন বর্তমান নিয়মেই অনুষ্ঠিত হবে। উচ্চকক্ষে দলগুলো সারা দেশে যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে আসন পাবে। দলগুলো যাতে উচ্চকক্ষে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে, সে বিষয়টি সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। রাষ্ট্রপতি মনোনীত পাঁচটি আসনের মাধ্যমে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার পরিকল্পনাও করা হয়েছে।
দীর্ঘদিনের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের দাবি পূরণের পথে ?
বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন থেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের দাবি জানিয়ে আসছে। বিএনপির ৬২ দফা প্রস্তাবের মধ্যেও এই প্রস্তাবটি উল্লেখ ছিল। জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনরাও এই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও একই ধরনের সুপারিশ করতে যাচ্ছে।
সংস্কার প্রস্তাবের অন্যান্য দিক
কমিশনগুলোর প্রতিবেদনে শুধু সংসদ কাঠামো নয়, আরও মৌলিক সংস্কারের সুপারিশ করা হবে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে আরো বেশি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ করার সুপারিশ থাকছে। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন, ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা, এবং প্রার্থীদের হলফনামায় বিদেশি সম্পদের বিবরণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপের প্রস্তাবও করা হয়েছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, “আমরা এমনভাবে সুপারিশ করছি যাতে ক্ষমতা আর এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ ও ভারসাম্য নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য।” একইসঙ্গে তিনি বলেছেন, এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত আরো বেশি শক্তিশালী হবে।
রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন
সংসদ নির্বাচন ও সংশ্লিষ্ট সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও তা দূর করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেছেন, “রাজনৈতিক মতপার্থক্য এমন কিছু নয় যা দূর করা যাবে না।” অন্তর্বর্তী সরকার কমিশনগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে। আলোচনা সফল হলে একটি সর্বসম্মত রূপরেখা তৈরি হতে পারে।
সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার এই প্রস্তাব দীর্ঘমেয়াদি সাংবিধানিক সংস্কারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। ক্ষমতার ভারসাম্য, নির্বাচনব্যবস্থা, এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিয়ে কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে বলে আশা করা যায়।
প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিবেদনের তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে।