যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) মেটা প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিট্রাস্ট মামলা দায়ের করেছে, অভিযোগ করে যে কোম্পানিটি ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতাকে দমন করে সামাজিক মাধ্যমে একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রেখেছে। ২০২৫ সালের ১৪ এপ্রিল ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন জেলা বিচারক জেমস বোসবার্গের অধীনে শুরু হওয়া এই বিচার মেটাকে ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপ বিক্রি করতে বাধ্য করতে পারে, যা সামাজিক মাধ্যমের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন চলমান মামলার মূল বিষয়গুলো তুলে ধরে, যাতে তথ্যের সঠিকতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হয় এবং পুনরাবৃত্তি বা অপ্রমাণিত দাবি এড়ানো হয়।
এফটিসির অভিযোগ: প্রতিযোগিতাবিরোধী অধিগ্রহণ
এনপিআর-এর প্রতিবেদক ববি অ্যালিন জানিয়েছেন, এফটিসি দাবি করেছে যে মেটা ২০১২ সালে ইনস্টাগ্রাম এবং ২০১৪ সালে হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণের মাধ্যমে একটি “ক্রয় বা ধ্বংস” কৌশল গ্রহণ করেছিল। এফটিসির মতে, তৎকালীন ফেসবুক নামে পরিচিত মেটা এই উদীয়মান প্রতিযোগীদের নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা থেকে বিরত রাখতে তাদের কিনে নিয়েছিল। এফটিসি উল্লেখ করেছে, মেটার সিইও মার্ক জাকারবার্গের অভ্যন্তরীণ ইমেইল থেকে জানা যায়, তিনি ২০১২ সালে ইনস্টাগ্রামের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ইনস্টাগ্রামকে মোবাইল ফটো শেয়ারিংয়ে একটি “বড় এবং কার্যকর প্রতিযোগী” হিসেবে উল্লেখ করেন, যা সামাজিক মাধ্যমের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একইভাবে, হোয়াটসঅ্যাপকে তিনি একটি “বড় ঝুঁকি” হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন, যা একটি প্রতিযোগী সামাজিক নেটওয়ার্কে রূপান্তরিত হতে পারত।
গ্লোবাল কম্পিটিশন রিভিউ-এর প্রতিবেদক আনা ল্যাংলোয়া জানান, এফটিসির একজন বিশেষজ্ঞ সাক্ষী, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জিহুন রিম, সাক্ষ্য দিয়েছেন যে ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপ মেটার হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে সফল হওয়ার “উচ্চ সম্ভাবনা” ছিল। এই সাক্ষ্য এফটিসির দাবিকে শক্তিশালী করে যে মেটার অধিগ্রহণ উদ্ভাবনকে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং ভোক্তাদের বিকল্প সামাজিক নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম থেকে বঞ্চিত করেছে। এফটিসি আরও অভিযোগ করেছে যে মেটার আধিপত্যের কারণে পরিষেবার মান কমেছে, যেমন বিজ্ঞাপনের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির মতো গোপনীয়তা লঙ্ঘন, যা প্রতিযোগিতার অভাবে ভোক্তাদের ক্ষতির প্রমাণ।
মেটার প্রতিরক্ষা: উদ্ভাবন এবং প্রতিযোগিতা
মেটা তাদের অধিগ্রহণ ভোক্তাদের জন্য উপকারী ছিল বলে দৃঢ় প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছে। বিজনেস ইনসাইডার-এর প্রতিবেদক সিডনি ব্র্যাডলি জানিয়েছেন, মেটার আইনজীবী দল, মার্ক হ্যানসেনের নেতৃত্বে, উদ্বোধনী বক্তৃতায় একটি ৮৮-স্লাইডের উপস্থাপনা দিয়েছে, যেখানে তারা টিকটক, ইউটিউব, এক্স এবং আইমেসেজের মতো প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার কথা উল্লেখ করেছে। হ্যানসেন জানান, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে টিকটকের একটি সংক্ষিপ্ত বিভ্রাটের সময় ব্যবহারকারীদের তথ্য ইনস্টাগ্রাম এবং ফেসবুকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে সরাসরি প্রতিযোগিতা প্রমাণ করে। মেটা দাবি করেছে, তাদের বিনিয়োগ ইনস্টাগ্রামকে একটি ছোট অ্যাপ থেকে দুই বিলিয়নের বেশি মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত করেছে, এবং হোয়াটসঅ্যাপ একটি নিরাপদ, এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড মেসেজিং পরিষেবায় পরিণত হয়েছে।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর প্রতিবেদক ক্যাট জাকরজেউস্কি জানান, জাকারবার্গ তার সাক্ষ্যে বলেছেন, মেটার অধিগ্রহণ ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নত করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। তিনি ২০১১ সালে ইনস্টাগ্রামের উন্নত ক্যামেরা এবং ফিল্টারের প্রশংসা করেন, স্বীকার করে যে মেটার নিজস্ব ফটো-শেয়ারিং প্রচেষ্টা পিছিয়ে ছিল। তিনি বলেন, “ইনস্টাগ্রাম এই ক্ষেত্রে ভালো ছিল, তাই আমি মনে করেছি তাদের কেনা ভালো।” মেটা আরও যুক্তি দিয়েছে যে এফটিসির “ব্যক্তিগত সামাজিক নেটওয়ার্কিং” বাজারের সংজ্ঞা অত্যন্ত সংকীর্ণ, যা টিকটক এবং ইউটিউবের মতো বৃহত্তর কনটেন্ট-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলোকে বাদ দেয়।
জাকারবার্গের ইমেইল এবং কৌশলগত উদ্বেগ
বিচারের সময় উপস্থাপিত অভ্যন্তরীণ ইমেইলগুলো মূল আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র টেক ডেস্ক জানায়, জাকারবার্গ ২০১১ সালে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন যে গুগল ইনস্টাগ্রাম কিনে নিতে পারে, যা এটিকে একটি শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারত। ২০১২ সালে তৎকালীন চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গকে লেখা একটি ইমেইলে জাকারবার্গ ইনস্টাগ্রামকে প্রতিযোগী হিসেবে নির্মূল করার কথা উল্লেখ করেন, যা এফটিসি প্রতিযোগিতাবিরোধী উদ্দেশ্যের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করছে। টেকক্রাঞ্চ-এর প্রতিবেদক সারাহ পেরেজ জানান, জাকারবার্গ ২০১৮ সালে অ্যান্টিট্রাস্ট তদন্তের ভয়ে ইনস্টাগ্রামকে আলাদা করার কথা বিবেচনা করেছিলেন। একটি অভ্যন্তরীণ নথিতে তিনি উল্লেখ করেন, ভবিষ্যতে কোনো প্রশাসন মেটাকে ইনস্টাগ্রাম বা হোয়াটসঅ্যাপ বিক্রি করতে বাধ্য করতে পারে।
ডব্লিউসিসিএফটেক-এর প্রতিবেদক এজ্জা ইজাজ জানান, ২০২২ সালের এপ্রিলে জাকারবার্গ এবং মেটার ফেসবুক প্রধান টম অ্যালিসনের মধ্যে ইমেইল বিনিময়ে জাকারবার্গ স্বীকার করেছেন যে ফেসবুকের সাংস্কৃতিক প্রাসঙ্গিকতা “দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।” তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে এই হ্রাস ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপ ভালো পারফর্ম করলেও। এই ইমেইলগুলো ফেসবুকের আকর্ষণ বজায় রাখতে মেটার অভ্যন্তরীণ সংগ্রামকে তুলে ধরে, বিশেষ করে যখন তরুণ ব্যবহারকারীরা টিকটক এবং ইনস্টাগ্রামের দিকে ঝুঁকছেন।
সাংস্কৃতিক প্রাসঙ্গিকতা এবং বাজারের গতিশীলতা
মামলায় ফেসবুকের ক্রমহ্রাসমান সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ম্যাশেবল ইন্ডিয়া-র প্রতিবেদক প্রিয়া সিং জানান, জাকারবার্গ স্বীকার করেছেন যে ফেসবুকে “বন্ধুত্ব এবং বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ারিং” হ্রাস পাচ্ছে। তিনি বলেন, বন্ধুদের সঙ্গে সংযোগ মেটার মিশনের কেন্দ্রে থাকলেও, প্ল্যাটফর্মটি কনটেন্ট আবিষ্কারের দিকে মনোযোগ দিয়েছে, যা টিকটকের মতো প্রতিযোগীদের প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পিসি গেমার-এর প্রতিবেদক জেরেমি লেয়ার্ড জানান, জাকারবার্গ ফেসবুকের বন্ধু তালিকা ফিচারটি মুছে ফেলার মতো কঠোর পদক্ষেপের কথাও বিবেচনা করেছিলেন, যাতে প্ল্যাটফর্মটি আধুনিক সামাজিক মাধ্যমের প্রবণতার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক থাকে।
সিসিএন.কম-এর প্রতিবেদক জিউসেপ্পে সিক্কোমাসকোলো জানান, মেটার শেয়ারহোল্ডাররা এই মামলা নিয়ে তুলনামূলকভাবে উদ্বিগ্ন নন, সম্ভবত কোম্পানির শক্তিশালী আর্থিক কর্মক্ষমতা এবং বৈচিত্র্যময় পোর্টফোলিওর কারণে। তবে, মামলার ফলাফল প্রযুক্তি শিল্পের জন্য ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে অধিগ্রহণ এবং একীভূতকরণের তদন্তের ক্ষেত্রে। ভেরফাসুংসব্লগ-এর প্রতিবেদক সারাহ হিনক জানান, এই মামলা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মিলে বিগ টেকের বাজার আধিপত্যের উপর কঠোর অ্যান্টিট্রাস্ট তদন্তের প্রতিফলন।
বিশেষজ্ঞ মতামত এবং আইনি চ্যালেঞ্জ
অ্যান্টিট্রাস্ট বিশেষজ্ঞরা দ্য ফেডারালিস্ট সোসাইটির প্রতিবেদক ড্যানিয়েল গিলম্যান জানান, এফটিসিকে প্রমাণ করতে হবে যে মেটার অধিগ্রহণ প্রতিযোগিতার ক্ষতি করেছে, যা একটি জটিল কাজ কারণ ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপ স্বাধীনভাবে সফল হতো কিনা তা অনুমান করা কঠিন। এফটিসিকে বিচারক বোসবার্গকে বোঝাতে হবে যে “ব্যক্তিগত সামাজিক নেটওয়ার্কিং” বাজারের সংজ্ঞা আজও প্রাসঙ্গিক, যদিও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের উত্থান ঘটেছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর টেক ডেস্ক জানায়, বিচারের প্রথম সপ্তাহে স্যান্ডবার্গের সাক্ষ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত উঠে এসেছে, যিনি মেটার অধিগ্রহণ কৌশলকে প্রতিযোগিতামূলক হিসেবে সমর্থন করেছেন।
ভিওআই.আইডি-র প্রতিবেদক আরি জুলিয়ান্তো জানান, এফটিসির মামলা মেটার কৌশলগত অধিগ্রহণের প্রমাণ দ্বারা শক্তিশালী, তবে মেটার যুক্তি যে তারা উদ্ভাবনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নত করেছে তা একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ। গুরুফোকাস-এর নিউজ ডেস্ক জানায়, জোরপূর্বক বিভাজন মেটার বিজ্ঞাপন ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যা ইনস্টাগ্রামের আয়ের উপর নির্ভরশীল, যা মেটার মার্কিন বিজ্ঞাপন আয়ের অর্ধেক।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যৎ প্রভাব
এই মামলা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রশাসনের প্রথম বড় অ্যান্টিট্রাস্ট মামলা। ইয়াহু ফাইন্যান্স-এর প্রতিবেদক অ্যালেক্সিস কিনান জানান, মেটার সাম্প্রতিক পদক্ষেপ, যার মধ্যে ট্রাম্পের উদ্বোধনী তহবিলে ১ মিলিয়ন ডলারের দান অন্তর্ভুক্ত, সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা তৈরি করেছে। তবে, এফটিসি চেয়ার অ্যান্ড্রু ফার্গুসন বলেছেন, তার দল “প্রস্তুত” আছে, যদিও তিনি আইনি রাষ্ট্রপতির নির্দেশ মানবেন। ইসিআর-এর নিউজ ডেস্ক জানায়, এফটিসির জয় মেটার ঐতিহাসিক বিভাজনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা ১৯৮০-এর দশকে এটি অ্যান্ড টি-এর বিভাজনের পর থেকে বিরল।
এফটিসির অ্যান্টিট্রাস্ট মামলা ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপের অধিগ্রহণ প্রতিযোগিতাবিরোধী ছিল কিনা তা প্রমাণ করার উপর নির্ভর করছে, যখন মেটা তাদের পদক্ষেপকে উদ্ভাবনী এবং ভোক্তা-বান্ধব হিসেবে প্রতিরক্ষা করছে। এই মামলার ফলাফল ডিজিটাল যুগে অ্যান্টিট্রাস্ট প্রয়োগকে পুনর্নির্ধারণ করতে পারে, যা শুধু মেটা নয়, বৃহত্তর প্রযুক্তি শিল্পের উপর প্রভাব ফেলবে। জাকারবার্গ এবং স্যান্ডবার্গের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাক্ষ্যসহ প্রমাণ উন্মোচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, আদালত সিদ্ধান্ত নেবে মেটার সামাজিক মাধ্যম সাম্রাজ্য এই আইনি চ্যালেঞ্জ সামলাতে পারবে কিনা।