গ্রিনল্যান্ডকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ডেনমার্কের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডকে ‘অবশ্যই পেতে হবে’ বলে বারবার মন্তব্য করেছেন, যা আর্কটিক অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্ব এবং সম্পদের প্রতি মার্কিন আগ্রহের ইঙ্গিত দেয়। এরই মধ্যে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এবং তার স্ত্রী উষা ভ্যান্সের গ্রিনল্যান্ড সফরের পরিকল্পনা এই উত্তেজনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই ঘটনার বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো।

ট্রাম্পের দাবি ও গ্রিনল্যান্ডের প্রতি মার্কিন আগ্রহ
‘আল জাজিরা ইংলিশ’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প জেডি ভ্যান্সের সফরের আগে আবারও জোর দিয়ে বলেছেন যে, গ্রিনল্যান্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘অপরিহার্য’। তিনি এই দ্বীপের কৌশলগত গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন, যা আর্কটিক অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বিস্তারের একটি অংশ। একইভাবে, ‘দ্য জেরুজালেম পোস্ট’-এর খবরে ট্রাম্পের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে, “আমাদের গ্রিনল্যান্ড দরকার।” এই মন্তব্য গ্রিনল্যান্ডের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং এর খনিজ সম্পদের প্রতি মার্কিন আগ্রহকে স্পষ্ট করে।

‘ফোর্ট বেন্ড হেরাল্ড’-এর প্রতিবেদনে ক্যামিলে বাস-ওহলার্ট ও আসাদ হাশিম জানিয়েছেন, ট্রাম্পের এই বক্তব্য ভ্যান্সের সফরের প্রাক্কালে এসেছে, যা গ্রিনল্যান্ড ও ডেনমার্কের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। একই তথ্য ‘ফেয়ারফিল্ড সান টাইমস’, ‘ওবার্ন ডেইলি টাইমস’, ‘কেটিইএন’, ‘কেএইচকিউ রাইট নাউ’, ‘ডগলাস বাজেট’ এবং ‘কুর্দিস্তান২৪’-এর প্রতিবেদনেও পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। এই সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুসারে, ট্রাম্পের বক্তব্য শুধু কৌশলগত নয়, বরং গ্রিনল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসনের প্রতি চাপ সৃষ্টির ইঙ্গিত হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

ভ্যান্স দম্পতির সফর: পরিকল্পনা ও পরিবর্তন
‘ইউএসএ টুডে’-তে কিম হজেলগার্ডের প্রতিবেদন অনুসারে, উষা ভ্যান্সের গ্রিনল্যান্ড সফর মূলত একটি ডগস্লেড রেসে অংশগ্রহণের জন্য পরিকল্পিত হয়েছিল। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়, যা কূটনৈতিক সংবেদনশীলতার কারণে বলে মনে করা হচ্ছে। ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর খবরে বলা হয়েছে, ডগস্লেড রেসের পরিবর্তে ভ্যান্স দম্পতি এখন গ্রিনল্যান্ডে অবস্থিত একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি পরিদর্শন করবেন। এই পরিবর্তনকে অনেকে ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের প্রতিবাদের ফল হিসেবে দেখছেন।

‘চ্যাটানুগা টাইমস ফ্রি প্রেস’-এর ডেভিড কিটন, ড্যানিকা কিরকা ও জশ বোয়াক জানিয়েছেন, জেডি ভ্যান্সের সফরের পরিকল্পনায় পরিবর্তন এসেছে, যা গ্রিনল্যান্ড ও ডেনমার্কের জন্য ‘সতর্ক স্বস্তি’ এনেছে। ‘ডব্লিউকেএমএস’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভ্যান্স ও তার স্ত্রী গ্রিনল্যান্ডে প্রতিবাদের মুখে তাদের সফরের পরিকল্পনা পরিবর্তন করেছেন। ‘রেডউড নিউজ’-এ ড্যানি কেম্পের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ট্রাম্পের চাপের মধ্যেই জেডি ভ্যান্স গ্রিনল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন।

ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের প্রতিক্রিয়া
‘পলিটিকো’ ও ‘ইয়াহু’-তে সেব স্টারসেভিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী গ্রিনল্যান্ডের জনগণকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, “আপনারা ট্রাম্পের কাছে নতি স্বীকার করেননি।” এটি গ্রিনল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসনের প্রতি ডেনমার্কের সমর্থনের প্রতিফলন। ‘সোশ্যাল নিউজ এক্সওয়াইজেড’-এ গোপী আদুসুমিল্লি জানিয়েছেন, ডেনমার্ক মার্কিন উদ্দেশ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যদিও সফরের পরিধি কমানো হয়েছে।

‘ডেইলি মেইল’-এ ব্রিটানি চেইনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রিনল্যান্ড উষা ভ্যান্সের সফরের আগে ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নিয়েছে এবং এই সফরের পেছনে ‘গোপন উদ্দেশ্য’ থাকার অভিযোগ তুলেছে। ‘ইয়াহু’ ও ‘দ্য ডেইলি বিস্ট’-এ এমেল ডেরা অ্যাডলফাস জানিয়েছেন, গ্রিনল্যান্ডের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান উষা ভ্যান্সের আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করেছে, যা কূটনৈতিক সম্পর্কের উপর চাপের ইঙ্গিত দেয়।

‘দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল’-এ স্টাইন জ্যাকবসেন, জ্যাকব গ্রোনহোল্ট ও লুইস রাসমুসেনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডগস্লেড রেসে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে ডেনমার্ক স্বাগত জানিয়েছে। ‘রয়টার্স’-এ একই তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের সঙ্গে বিরোধের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত এসেছে। ‘চায়না ডেইলি’-তে বলা হয়েছে, ডেনমার্ক ভ্যান্সের সফর নিয়ে ক্ষুব্ধ, যাকে তারা গ্রিনল্যান্ড দখলের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা
‘দ্য হিল’-এ লরা কেলির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড নিয়ে তার পদ্ধতি পরিবর্তন করেছেন, যা জনসম্মুখে সমালোচনা ও সিগন্যাল কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে এসেছে। ‘ডব্লিউএসডব্লিউএস’-এ জর্ডান শিলটন গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণকে ‘আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের দীর্ঘদিনের লক্ষ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ‘দ্য নিউ রিপাবলিক’ ও ‘ইয়াহু’-তে এলি কুইনলান হাউটালিং লিখেছেন, উষা ভ্যান্সের সফর ট্রাম্পের জন্য ‘আরও বিব্রতকর’ হয়ে উঠেছে।

‘আইরিশ স্টার’-এ দেবদ্রিতা সুর জানিয়েছেন, জেডি ভ্যান্স গ্রিনল্যান্ডে সব জনসম্মুখে অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন, যা ট্রাম্পের আর্কটিক পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদের ফল। ‘ট্রিবলাইভ.কম’-এ বলা হয়েছে, জেডি ভ্যান্স গ্রিনল্যান্ড সফরে যোগ দিয়েছেন, যখন ট্রাম্প দ্বীপটিকে ‘প্রয়োজনীয়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

গ্রিনল্যান্ড নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ এবং ভ্যান্স দম্পতির সফরের পরিকল্পনা ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ট্রাম্পের বক্তব্য ও মার্কিন পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তা কূটনৈতিক সমাধানের দিকে যাবে নাকি আরও জটিলতার সৃষ্টি করবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে এটি পরিষ্কার যে, এই ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version