ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানবজীবনের প্রতিটি দিককে সুসংহত ও ভারসাম্যপূর্ণ করে তোলে। ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে যাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা শুধু আধ্যাত্মিক নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যাকাত শব্দের অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্রতা অর্জন করা এবং প্রশংসা করা। এটি সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরিব ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র করে এবং সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখে। এই নিবন্ধে যাকাতের সংজ্ঞা, শর্ত, প্রযোজ্যতা, ইসলামী রাষ্ট্রের ভূমিকা এবং এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
যাকাতের সংজ্ঞা ও তাৎপর্য
যাকাত ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়। এটি একটি আর্থিক ইবাদত, যা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিকদের উপর ফরজ করা হয়েছে। যাকাত শুধু গরিবদের সাহায্য করার মাধ্যম নয়, বরং এটি সম্পদশালীদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয় এবং সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয়।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো এবং যাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্য যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা করো, আল্লাহ তা দেখেন।”
(সূরা আলবাকারাহ, ২:১১০)
এই আয়াতে সালাত ও যাকাতকে একসাথে উল্লেখ করা হয়েছে, যা যাকাতের গুরুত্বকে তুলে ধরে। যাকাত শুধু একটি আর্থিক কর্তব্য নয়, বরং এটি আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্য ও সমাজের প্রতি দায়িত্বের প্রকাশ।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত
যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ইসলামী শরীয়াহ কিছু শর্ত নির্ধারণ করেছে। এই শর্তগুলো পূরণ না হলে যাকাত ফরজ হয় না। নিম্নে যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তগুলো আলোচনা করা হলো:
১. মুসলমান হওয়া
যাকাত শুধুমাত্র মুসলমানদের উপর ফরজ। অমুসলিমদের উপর যাকাত ফরজ নয়।
২. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা
নিসাব হল সম্পদের একটি সর্বনিম্ন সীমা, যা সোনা, রূপা, নগদ অর্থ, ব্যবসায়িক পণ্য বা অন্যান্য সম্পদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নিসাবের পরিমাণ নিম্নরূপ:
সোনার নিসাব: ৮৫ গ্রাম (৭.৫ তোলা)।
রূপার নিসাব: ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫ তোলা)।
নগদ অর্থ বা ব্যবসায়িক পণ্য: সোনা বা রূপার নিসাবের সমপরিমাণ মূল্য থাকলে যাকাত ফরজ হয়।
৩. সম্পদের উপর এক বছর পূর্ণ হওয়া
সম্পদ নিসাব পরিমাণ থাকা সত্ত্বেও তা উপর এক বছর (চান্দ্র বছর) অতিক্রান্ত হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ, সম্পদ এক বছর ধরে নিসাব পরিমাণ থাকলে যাকাত ফরজ হয়।
৪. সম্পদ উৎপাদনশীল বা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকা
সম্পদ এমন হওয়া উচিত যা বৃদ্ধি পায় বা উৎপাদনশীল হয়, যেমন ব্যবসায়িক পণ্য, নগদ অর্থ, পশু ইত্যাদি।
যাকাতের হার ও প্রযোজ্য সম্পদ
যাকাতের হার সাধারণত সম্পদের ২.৫%। এটি মূলত সোনা, রূপা, নগদ অর্থ, ব্যবসায়িক পণ্য, কৃষি উৎপাদন ইত্যাদির উপর প্রযোজ্য। কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে যাকাতের হার ভিন্ন হতে পারে, যেমন সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলে ৫% এবং বৃষ্টির পানিতে উৎপাদিত ফসলে ১০% যাকাত দিতে হয়।
যাকাতের হকদার
কুরআনের সূরা আততাওবাহ (৯:৬০)এ আল্লাহ তাআলা যাকাতের হকদার বা গ্রহণকারীদের ৮টি শ্রেণি উল্লেখ করেছেন। এই আয়াতে বলা হয়েছে:
“যাকাত তো কেবল ফকীর, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী এবং যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, আর দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে (জিহাদে) এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”
এই আয়াত অনুসারে, যাকাতের হকদার ৮টি শ্রেণি নিম্নরূপ:
১. ফকীর (গরিব): যাদের আয় বা সম্পদ তাদের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
২. মিসকীন (অভাবগ্রস্ত): যাদের সম্পদ ফকীরের চেয়েও কম বা সম্পদশূন্য।
৩. যাকাত আদায়কারী (আমিল): যারা যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত।
৪. যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় (মুয়াল্লাফাতুল কুলুব): নতুন মুসলিম বা যাদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার প্রয়োজন হয়।
৫. দাসমুক্তির জন্য: দাস বা বন্দীদের মুক্ত করার উদ্দেশ্যে।
৬. ঋণগ্রস্ত: যারা ঋণের বোঝায় নিষ্পেষিত এবং তা পরিশোধ করতে অক্ষম।
৭. আল্লাহর পথে (ফী সাবিলিল্লাহ): আল্লাহর পথে জিহাদ বা ইসলামী কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সাহায্য।
৮. মুসাফির (পথিক): যাত্রাকালে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়া মুসাফির।
যাকাত আদায়ের সময়
যাকাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কোনো মাস বা সময় নেই। যাকাত ফরজ হওয়ার পর যেকোনো সময় তা আদায় করা যায়। তবে নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর দ্রুত আদায় করা উচিত। রমজান মাসে যাকাত আদায় করা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ, কারণ এই মাসে নেক আমলের সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়।
যাকাত না দেওয়ার পরিণতি
যাকাত ইসলামের একটি মৌলিক বিধান। যারা যাকাত আদায় করে না, তাদের জন্য ইসলামী শরীয়াহতে কঠোর সতর্কতা ও শাস্তির বিধান রয়েছে। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“যারা সোনা ও রূপা জমা করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।”
(সূরা আততাওবাহ, ৯:৩৪)
হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন কিন্তু সে তার যাকাত আদায় করে না, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে একটি বিষধর সাপের রূপে উপস্থিত করা হবে।”
(সহীহ বুখারী)
রাষ্ট্রের ভূমিকা
রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো যাকাত ব্যবস্থাপনা ও বিতরণ নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র যাকাত সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং সঠিকভাবে বিতরণের মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখে। ইসলামী রাষ্ট্রের ভূমিকা নিম্নরূপ:
১. যাকাত সংগ্রহ: রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ যাকাত আদায়ের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ করে।
২. যাকাত বিতরণ: রাষ্ট্র যাকাতের অর্থ সঠিকভাবে গরিব ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টন করে।
৩. যাকাত আদায়ে বাধ্য করা: রাষ্ট্র যাকাত আদায়ে অস্বীকারকারীদের বাধ্য করতে পারে।
৪. যাকাতের অপচয় রোধ: রাষ্ট্র যাকাতের অর্থের অপচয় ও দুর্নীতি রোধ করে।
৫. সামাজিক উন্নয়ন: রাষ্ট্র যাকাতের অর্থ ব্যবহার করে দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করে।
যাকাত ইসলামের একটি মৌলিক ইবাদত, যা সম্পদ পবিত্র করে এবং সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখে। এটি শুধু গরিবদের সাহায্য করার মাধ্যম নয়, বরং সম্পদশালীদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে। ইসলামী রাষ্ট্র যাকাত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি এবং সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করতে পারি।