প্রতি বছর ৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। এটি শুধু একটি উৎসব নয়, বরং নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কৃতিত্বের স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি লিঙ্গ সমতার জন্য সংগ্রামের একটি প্রতীক। এই দিনটির উৎপত্তি ১৯ শতকের শেষভাগ ও ২০ শতকের শুরুর শ্রমিক আন্দোলন এবং নারী অধিকারের দাবির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই নিবন্ধে আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবসের উদ্ভব, প্রথম পালন, এর বিবর্তন এবং আধুনিক বিশ্বে এর তাৎপর্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।


শিল্প বিপ্লব ও নারী শ্রমিকদের উত্থান
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শিকড় খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৮ শতকের শেষ ও ১৯ শতকের শিল্প বিপ্লবের সময়ে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় কারখানার উত্থানের ফলে নারীরা ব্যাপকভাবে শ্রমশক্তিতে যোগ দিতে শুরু করে, বিশেষ করে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস এবং অন্যান্য শিল্পে। কিন্তু তাদের কাজের পরিবেশ ছিল অমানবিক—দিনে ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ, ন্যূনতম মজুরি, এবং কোনো সামাজিক নিরাপত্তা ছিল না। পুরুষদের তুলনায় নারীদের মজুরি ছিল অনেক কম, এবং তাদের ওপর বৈষম্য আরোপ করা হতো।
এই শোষণের প্রতিবাদে নারী শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। একই সময়ে, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং নারী ভোটাধিকারের দাবি ইউরোপ ও আমেরিকায় গতি পায়। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ধারণা জন্ম নেয়।

প্রাথমিক প্রতিবাদ ও সূচনা
নারী দিবসের ইতিহাসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এর ভিত্তি তৈরি করে। যদিও সব ঘটনার সঠিকতা নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক আছে, তবু কিছু উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত এর উৎপত্তির সঙ্গে যুক্ত:
• ১৮৫৭ সালের বিতর্কিত ঘটনা: কিছু সূত্রে দাবি করা হয় যে, ৮ মার্চ, ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কে টেক্সটাইল শ্রমিক নারীরা কাজের পরিবেশ ও মজুরির দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন। তবে ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাবে এটিকে নারী দিবসের সরাসরি উৎস হিসেবে গণ্য করা হয় না। অনেকে মনে করেন এটি পরবর্তীকালে প্রচারিত একটি গল্প, যা নারী আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

• ১৯০৮ সালের নিউইয়র্ক মিছিল: ৮ মার্চ, ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে প্রায় ১৫,০০০ নারী শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসেন। তাদের দাবি ছিল ভোটাধিকার, কাজের সময় কমানো (তখন দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো), ন্যায্য মজুরি এবং শ্রম পরিবেশের উন্নতি। এই ঘটনাটি আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক দলের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে নারী দিবসের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।

• ১৯০৯ সালে জাতীয় নারী দিবস: আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক দল (Socialist Party of America) ১৯০৮ সালের এই বিক্ষোভের স্মরণে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৯ সালে প্রথম “জাতীয় নারী দিবস” পালন করে। এটি ছিল একটি আমেরিকাকেন্দ্রিক উদযোগ এবং পরবর্তী কয়েক বছর ফেব্রুয়ারির শেষ রোববারে পালিত হয়। এই দিনটি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়।


আন্তর্জাতিকীকরণের পথে
নারী দিবসকে জাতীয় সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব প্রধানত জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের (Clara Zetkin)। তিনি ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, যিনি নারী শ্রমিকদের অধিকার এবং লিঙ্গ সমতার জন্য সারা জীবন কাজ করেছেন।
• ১৯১০ সালের প্রস্তাব: ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ১৭টি দেশ থেকে আগত প্রায় ১০০ জন নারী প্রতিনিধি অংশ নেন। ক্লারা জেটকিন এখানে প্রথমবারের মতো একটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, এই দিনটি নারীদের ভোটাধিকার, শ্রম অধিকার এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবে। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, তবে তখনও কোনো নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করা হয়নি।

• ১৯১১ সালে প্রথম পালন: প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। এটি অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডে উদযাপিত হয়। এই দিনে প্রায় ১০ লাখ নারী ও পুরুষ রাস্তায় সমাবেশে অংশ নেন। তাদের মূল দাবি ছিল: নারীদের ভোট দেওয়ার অধিকার, শিক্ষা ও কাজের সমান সুযোগ, এবং শ্রম ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ। এই ঘটনা নারী অধিকার আন্দোলনের একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়।

৮ মার্চের উৎপত্তি
প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কোনো নির্দিষ্ট তারিখ ছিল না। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিনে এটি পালিত হতো। কিন্তু ৮ মার্চ কীভাবে এই দিবসের স্থায়ী তারিখ হয়ে উঠল, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত।
• ১৯১৪ সালের শান্তি সমাবেশ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে, ১৯১৪ সালের ৮ মার্চ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নারীরা শান্তির দাবিতে সমাবেশ করেন। এটি ৮ মার্চকে একটি প্রতীকী দিন হিসেবে চিহ্নিত করে।
• ১৯১৭ সালের রুশ আন্দোলন: ৮ মার্চের সঙ্গে নারী দিবসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ স্থাপিত হয় ১৯১৭ সালে। রাশিয়ায় তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল, এবং যুদ্ধের প্রভাবে খাদ্য সংকট ও দারিদ্র্য চরমে পৌঁছেছিল। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৭ সালে (জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে), যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ৮ মার্চ, রাশিয়ার পেট্রোগ্রাদে (বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গ) নারী শ্রমিকরা “রুটি ও শান্তি”র দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। এই আন্দোলন ক্রমে বড় আকার ধারণ করে এবং জারের পতন ও রুশ বিপ্লবের সূচনা করে। এই ঘটনার পর থেকে ৮ মার্চ নারীদের সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও জাতিসংঘের ভূমিকা
১৯১৭ সালের পর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ৮ মার্চকে নিয়মিতভাবে নারী দিবস হিসেবে পালন শুরু করে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে এটি তখনও ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নারী আন্দোলন নতুন গতি পায়, এবং ১৯৬০-এর দশকে নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় ঢেউ এই দিবসকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে।
• জাতিসংঘের স্বীকৃতি: ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ “আন্তর্জাতিক নারী বছর” ঘোষণা করে এবং ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেয়। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ রেজোলিউশন ৩২/১৪২ পাস করে, যাতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ৮ মার্চ “নারী অধিকার ও আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস” হিসেবে পালনের আহ্বান জানানো হয়। এরপর থেকে এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত দিন হয়ে ওঠে।
• থিম-ভিত্তিক উদযাপন: ১৯৯০-এর দশক থেকে জাতিসংঘ প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট থিম ঘোষণা করে এই দিবস পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের থিম ছিল “Invest in Women: Accelerate Progress”।


আধুনিক বিশ্বে আন্তর্জাতিক নারী দিবস
আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস শুধু একটি উদযাপন নয়, বরং লিঙ্গ বৈষম্য, নারী নির্যাতন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে অসমতার মতো বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর একটি প্ল্যাটফর্ম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি বিভিন্নভাবে পালিত হয়—কোথাও সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় (যেমন রাশিয়া, চীন), কোথাও সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
বাংলাদেশেও ৮ মার্চ গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নারীদের অগ্রগতি, শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে আলোচনা হয়। তবে এখনও গ্রামীণ এলাকায় নারীদের জন্য সমান সুযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জ।

তাৎপর্য ও ভবিষ্যৎ
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য এই যে, এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে নারীদের অধিকারের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। বিশ্বব্যাপী নারীরা এখনও বৈষম্য, নির্যাতন এবং সুযোগের অভাবের শিকার। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বের মোট শ্রমশক্তির মাত্র ৪৭% নারী, এবং তারা পুরুষদের তুলনায় গড়ে ২০% কম আয় করেন।
ভবিষ্যতে এই দিবসটি নারীদের কণ্ঠকে আরও শক্তিশালী করতে এবং লিঙ্গ সমতার লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এটি শুধু নারীদের জন্য নয়, সমাজের সামগ্রিক উন্নতির জন্যও অপরিহার্য।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস একটি শতাব্দী প্রাচীন সংগ্রামের ফসল। ১৯১১ সালে প্রথম পালিত এই দিনটি আজ বিশ্বব্যাপী নারীদের অধিকার ও কৃতিত্বের প্রতীক। ৮ মার্চ আমাদের অতীতের সংগ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং ভবিষ্যতের জন্য পথ দেখায়। এটি একটি উদযাপন, একটি আন্দোলন এবং একটি প্রতিশ্রুতি—যে আমরা একটি সমতাভিত্তিক বিশ্ব গড়তে কাজ করে যাব।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version