ধান চাষে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ফসলের ফলন বাড়াতে এবং গাছের পুষ্টির চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আপনি যে সারগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন—ইউরিয়া, টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট), এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) এবং অন্যান্য সার যেমন জিংক সালফেট বা সালফার—এগুলোর প্রত্যেকটির নির্দিষ্ট কাজ, প্রয়োগ পদ্ধতি এবং উপকারিতা রয়েছে। নিচে এই সারগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো:

 ১. ইউরিয়া:

 গঠন ও উৎস: ইউরিয়া (CO(NH₂)₂) হলো একটি রাসায়নিক সার যাতে প্রায় ৪৬% নাইট্রোজেন থাকে, যা এটিকে নাইট্রোজেনের সবচেয়ে ঘনীভূত উৎস করে।

 কাজ: নাইট্রোজেন ধান গাছের পাতা ও কাণ্ডের বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। এটি ক্লোরোফিল তৈরিতে সাহায্য করে, যা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাছের খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। পর্যাপ্ত নাইট্রোজেন না থাকলে গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

 প্রয়োগ সময় ও পদ্ধতি:

   জমি প্রস্তুতির সময়: সাধারণত জমিতে প্রাথমিক ডোজ হিসেবে ইউরিয়ার একটি অংশ (মোট পরিমাণের ১/৩) ছিটিয়ে বা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়।

   টপ ড্রেসিং: ধান গাছ বড় হওয়ার সময় ইউরিয়া ২৩ দফায় প্রয়োগ করা হয়:

     প্রথম দফা: চারা রোপণের ১৫২০ দিন পর, যখন গাছ শিকড় গাঢ়ভাবে গজায়।

     দ্বিতীয় দফা: কুশি বের হওয়ার সময় (৩০৪০ দিন), যখন নতুন কাণ্ড গজায়।

     তৃতীয় দফা: ফুল ফোটার আগে (৫০৬০ দিন), যাতে দানা ভরাট ভালো হয়।

   প্রতি হেক্টরে সাধারণত ১০০১৫০ কেজি ইউরিয়া ব্যবহার হয়, তবে মাটির উর্বরতার উপর নির্ভর করে পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে।

 প্রয়োগের কৌশল: ইউরিয়া জমিতে ছিটিয়ে দেওয়ার পর হালকা পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয়। পানি না থাকলে এটি বাতাসে উবে যেতে পারে (ভলাটিলাইজেশন)।

 সতর্কতা: অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহার গাছের ক্ষতি করতে পারে এবং মাটির অম্লত্ব বাড়াতে পারে।

 ২. টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট):

 গঠন ও উৎস: টিএসপি একটি ফসফরাস সমৃদ্ধ সার, যাতে প্রায় ৪৬৪৮% ফসফরাস (P₂O₅) থাকে। এটি রক ফসফেট থেকে তৈরি করা হয়।

 কাজ: ফসফরাস ধান গাছের শিকড় গঠন, শক্তি সঞ্চয় এবং ফুল ও ফল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ। এটি গাছের প্রাথমিক বৃদ্ধি এবং দানা উৎপাদনে সহায়তা করে। ফসফরাসের ঘাটতি হলে শিকড় দুর্বল হয় এবং ফলন কমে যায়।

 প্রয়োগ সময় ও পদ্ধতি:

   জমি প্রস্তুতির সময়: টিএসপি সাধারণত একবারই প্রয়োগ করা হয়, জমি চাষের শেষ ধাপে। এটি মাটির গভীরে মিশিয়ে দেওয়া হয়, কারণ ফসফরাস মাটিতে সহজে সরে না।

   প্রতি হেক্টরে ৫০৭০ কেজি টিএসপি ব্যবহার করা হয়, তবে মাটির ফসফরাসের মাত্রার উপর নির্ভর করে পরিমাণ নির্ধারণ করা উচিত।

 প্রয়োগের কৌশল: টিএসপি ছিটিয়ে দেওয়ার পর লাঙ্গল বা মই দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মেশানো হয়। এরপর পানি দিয়ে জমি ভিজিয়ে রাখা হয়।

 সুবিধা: দ্রুত শিকড় গঠনে সাহায্য করে এবং দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টি সরবরাহ করে।

 ৩. এমওপি (মিউরেট অব পটাশ):

 গঠন ও উৎস: এমওপি (KCl) হলো পটাশিয়াম ক্লোরাইড, যাতে প্রায় ৬০% পটাশিয়াম (K₂O) থাকে। এটি খনিজ থেকে উৎপন্ন হয়।

 কাজ: পটাশিয়াম গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, কোষের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং দানা ভরাটে সাহায্য করে। এটি গাছকে শক্তিশালী করে এবং পানির ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। পটাশিয়ামের ঘাটতি হলে গাছ দুর্বল হয় এবং ফলন কমে।

 প্রয়োগ সময় ও পদ্ধতি:

   জমি প্রস্তুতির সময়: প্রাথমিক ডোজ হিসেবে এমওপি জমিতে ছিটিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়।

   পরবর্তী প্রয়োগ: কখনো কখনো কুশি বের হওয়ার সময় বা ফুল ফোটার আগে অতিরিক্ত ডোজ দেওয়া যায়।

   প্রতি হেক্টরে ৫০৬০ কেজি এমওপি সাধারণত ব্যবহার করা হয়।

 প্রয়োগের কৌশল: এটি ছিটিয়ে বা শিকড়ের কাছে প্রয়োগ করে পানি দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়।

 সুবিধা: ফসলের গুণগত মান বাড়ায় এবং প্রতিকূল আবহাওয়ায় গাছকে টিকিয়ে রাখে।

 ৪. অন্যান্য সার (জিংক সালফেট ও সালফার):

 জিংক সালফেট (ZnSO₄):

   কাজ: জিংক গাছের হরমোন তৈরি এবং পাতার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। জিংকের ঘাটতি হলে পাতায় সাদা দাগ দেখা যায় এবং বৃদ্ধি কমে।

   প্রয়োগ: মাটিতে জিংকের ঘাটতি থাকলে হেক্টরপ্রতি ৫১০ কেজি জিংক সালফেট জমি প্রস্তুতির সময় বা চারা রোপণের পর প্রয়োগ করা হয়। এটি পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করাও যায়।

 সালফার:

   কাজ: সালফার প্রোটিন তৈরি এবং গাছের বিপাক প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। এর ঘাটতি হলে পাতা হলুদ হয়।

   প্রয়োগ: হেক্টরপ্রতি ১০১৫ কেজি সালফার জমিতে ছিটিয়ে মিশিয়ে দেওয়া হয়।

 সাধারণ পরামর্শ:

 মাটি পরীক্ষা: সারের সঠিক পরিমাণ নির্ধারণের জন্য মাটির পুষ্টি মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত।

 সমন্বিত ব্যবহার: ইউরিয়া, টিএসপি এবং এমওপি একসঙ্গে সঠিক অনুপাতে ব্যবহার করলে ফলন সর্বোচ্চ হয়। উদাহরণস্বরূপ, N:P:K অনুপাত ১০০:৫০:৫০ হতে পারে।

 পরিবেশগত বিবেচনা: অতিরিক্ত সার ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে, কারণ এটি পানি দূষণ ও মাটির ক্ষতি করতে পারে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version