ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্য সাময়িকভাবে স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। এই সিদ্ধান্তের পেছনে শান্তি প্রক্রিয়ায় অগ্রগতির লক্ষ্য থাকলেও এটি ইউক্রেন ও তার মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এই ঘটনার নানা দিক তুলে ধরেছে। তাদের প্রতিবেদনের আলোকে এই সংকটের একটি সমন্বিত চিত্র তুলে ধরা হলো।
‘‘ভয়েস অফ এমেরিকা (VOA)’’ জানিয়েছে, হোয়াইট হাউস সোমবার ঘোষণা করেছে যে ট্রাম্প ইউক্রেনের জন্য সামরিক সাহায্য সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। একজন সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তা VOA-কে বলেন, “প্রেসিডেন্ট পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তিনি শান্তির দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। এই লক্ষ্যে আমাদের অংশীদারদের অঙ্গীকারও আমাদের জন্য প্রয়োজন। আমরা আমাদের সাহায্যে সাময়িক বিরতি টেনে পর্যালোচনা করছি, যাতে এটা একটা সমাধানে অবদান রাখতে পারে।” ট্রাম্প সোমবার সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে জেলেনস্কির একটি মন্তব্যকে “সবচেয়ে খারাপ বক্তব্য” বলে সমালোচনা করেন। জেলেনস্কি বলেছিলেন, রাশিয়ার সাথে যুদ্ধের সমাপ্তি “এখনো অনেক দূরে”। ট্রাম্পের মতে, “আমেরিকা আর বেশি দিন এসব মেনে নেবে না।”
‘‘বিবিসি বাংলা’’ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা স্থগিতের ঘোষণা এসেছে হোয়াইট হাউস থেকে। একজন কর্মকর্তা বিবিসির অংশীদার সিবিএস নিউজকে বলেন, “প্রেসিডেন্ট স্পষ্টভাবে বলেছেন শান্তি প্রতিষ্ঠাই তার মূল লক্ষ্য। আমাদের অংশীদারদের এই লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা প্রয়োজন।” বিবিসি আরও জানায়, ট্রাম্প জেলেনস্কিকে “কৃতজ্ঞ” হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, “আমরা দেখব কী হয়।” ‘‘ব্লুমবার্গ’’-এর একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি জানায়, ট্রাম্প যতক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছেন যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তিতে আগ্রহী, ততক্ষণ সামরিক সহায়তা স্থগিত থাকবে। এমনকি পোল্যান্ডের ডিপোতে মজুদ অস্ত্র সরবরাহও এই সিদ্ধান্তের আওতায় পড়বে।
‘‘প্রথম আলো’’ তাদের প্রতিবেদনে, যার উৎস হিসেবে ‘‘দ্য গার্ডিয়ান’’-এর উল্লেখ করেছে, জানিয়েছে যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সাথে উত্তপ্ত বৈঠকের পর ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। জেলেনস্কি বলেন, “এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা যখন প্রকাশ্যে হয় তখন শত্রুরা তার সুযোগ নেয়।” তিনি আশা করছেন, হোয়াইট হাউসে যা ঘটেছে তা ঠিক হয়ে যাবে। প্রথম আলো আরও জানায়, জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে খনিজ চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু বৈঠক ভেস্তে যাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। জেলেনস্কি ব্রিটেন থেকে সাংবাদিকদের বলেন, “আমি ট্রেনে ১২ ঘণ্টা, উড়োজাহাজে ১১ ঘণ্টা ভ্রমণ করেছি কারণ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রধান অংশীদার।”
‘‘বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’’ জানিয়েছে, ট্রাম্প ইউক্রেনের খনিজ চুক্তি নিয়ে এখনও আশাবাদী। সোমবার হোয়াইট হাউসে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “না, আমার তা মনে হয় না।” ‘‘রয়টার্স’’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বিডিনিউজ জানায়, ট্রাম্প এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি “বড় ধরনের চুক্তি” বলে বর্ণনা করেছেন। মঙ্গলবার মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে তিনি চুক্তির সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরবেন বলে জানান। বিডিনিউজ আরও জানায়, গত শুক্রবার জেলেনস্কির সাথে বৈঠকে উত্তেজনার কারণে চুক্তি স্বাক্ষর ভেস্তে যায়, যদিও এর শর্তাবলী নিয়ে আগেই মতৈক্য হয়েছিল।
‘‘ফক্স নিউজ’’-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কি “অধিকার ফলাতে গিয়েছিলেন” এবং “সম্মানের অভাব” দেখিয়েছেন। ভ্যান্স ফক্স নিউজের হোস্ট শন হ্যানিটিকে বলেন, “শান্তি প্রক্রিয়ায় জড়িত হতে জেলেনস্কি স্পষ্টতই অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।” তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে জেলেনস্কি শান্তি আলোচনায় আসবেন। ভ্যান্স বলেন, “যতক্ষণ জেলেনস্কি সিরিয়াসলি শান্তি আলোচনা করতে ইচ্ছুক, ততক্ষণ ওভাল অফিসের দরজা খোলা থাকবে।”
ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়া ও শান্তি প্রচেষ্টার খবরে কি কি জানা গেলো ?
‘‘বিবিসি বাংলা’’ জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার চার দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার জন্য। তিনি বলেন, “এটা আরও বৈঠকের সময় নয়, এটা পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।” ‘‘প্রথম আলো’’ ও ‘‘দ্য গার্ডিয়ান’’ জানায়, জেলেনস্কি লন্ডনে ইউরোপীয় নেতাদের সাথে সাক্ষাতের পর শান্তি প্রচেষ্টায় ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে আশাবাদী। তিনি ইঙ্গিত দেন, তুরস্ক, বাল্টিক ও নরডিক দেশগুলো এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারে।
‘‘বিবিসি বাংলা’’ আরও জানায়, সিনেটর ট্যামি ডাকওয়ার্থ সামরিক সহায়তা স্থগিতকরণকে “ইউক্রেনকে লজ্জাজনকভাবে ত্যাগ করার নজির” বলে সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “এই সিদ্ধান্ত আমাদের গণতান্ত্রিক অংশীদারদের সাথে সম্পর্ক দুর্বল করবে।” ভারমন্টের সিনেটর পিটার ওয়েলচ বলেন, “পুতিন একজন যুদ্ধাপরাধী। জেলেনস্কি একজন নায়ক। ট্রাম্প দুর্বল।”
ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ফলে ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে একটি নতুন টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। ‘‘ভয়েস অফ এমেরিকা’’ ও ‘‘বিবিসি বাংলা’’ শান্তির জন্য ট্রাম্পের জোর দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরলেও ‘‘প্রথম আলো’’ ও ‘‘দ্য গার্ডিয়ান’’ জেলেনস্কির কৌশল ও নিরাপত্তার শর্তের উপর আলোকপাত করেছে। ‘‘বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’’ খনিজ চুক্তির সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়েছে, আর ‘‘ফক্স নিউজ’’ জেলেনস্কির আচরণের সমালোচনা তুলে ধরেছে। পরিস্থিতি এখনো তরল, এবং ভবিষ্যৎ কী নিয়ে আসবে তা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব সম্প্রদায়।