ইতিহাসের প্রথম ল্যাটিন আমেরিকান পোপ ফ্রান্সিস, যিনি তার নম্র আচরণ এবং দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতির জন্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত, ৮৮ বছর বয়সে সোমবার (২১ এপ্রিল ২০২৫) মারা গেছেন। তার মৃত্যুর খবর ভ্যাটিকানের কার্ডিনাল কেভিন ফারেল কর্তৃক ঘোষণা করা হয়, যিনি জানান, সকাল ৭:৩৫ মিনিটে পোপ ফ্রান্সিস “প্রভুর ঘরে ফিরে গেছেন।” এই প্রতিবেদনটি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে প্রতিটি তথ্যের উৎস এবং প্রতিবেদকের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এপি নিউজের প্রতিবেদক নিকোল উইনফিল্ড জানিয়েছেন, পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর ঘোষণা ভ্যাটিকানের ডোমাস সান্তা মার্তার চ্যাপেল থেকে কার্ডিনাল কেভিন ফারেল দ্বারা পাঠ করা হয়। তিনি বলেন, “আজ সকাল ৭:৩৫ মিনিটে রোমের বিশপ ফ্রান্সিস প্রভুর ঘরে ফিরে গেছেন। তার পুরো জীবন ছিল প্রভু এবং তাঁর গির্জার সেবায় নিবেদিত।” এই ঘোষণার পর আর্জেন্টিনা থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত গির্জার ঘণ্টা বাজতে শুরু করে।
এপি নিউজ আরও জানায়, পোপ ফ্রান্সিস দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছিলেন। তিনি ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ ব্রঙ্কাইটিসের কারণে জেমেলি হাসপাতালে ভর্তি হন, যেখানে পরবর্তীতে তার উভয় ফুসফুসে নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। ৩৮ দিন হাসপাতালে থাকার পর তিনি তার ভ্যাটিকানের বাসভবন কাসা সান্তা মার্তায় ফিরে আসেন।

এপি নিউজের প্রতিবেদন অনুসারে, পোপ ফ্রান্সিস তার মৃত্যুর একদিন আগে, ইস্টার সানডে-তে সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে হাজার হাজার মানুষের উদ্দেশে আশীর্বাদ প্রদান করেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি প্রচণ্ড উল্লাস ও করতালির মধ্যে আশীর্বাদ প্রদান করেন এবং এটিই ছিল তার শেষ সর্বজনীন উপস্থিতি। এর আগে তিনি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে সংক্ষিপ্তভাবে সাক্ষাৎ করেন।
তার স্বাস্থ্যগত ইতিহাস সম্পর্কে এপি নিউজ জানায়, তরুণ বয়সে আর্জেন্টিনায় পোপ ফ্রান্সিসের একটি ফুসফুসের অংশ অপসারণ করা হয়েছিল গুরুতর শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রায়ই শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ভুগতেন। ২০২৩ সালের নভেম্বরে তিনি ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং ফুসফুসের প্রদাহের কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি পরিকল্পিত সফর বাতিল করেন।

ভ্যাটিকান রেডিওর প্রতিবেদক ডেভিন ওয়াটকিন্স জানিয়েছেন, কার্ডিনাল কেভিন ফারেল সকাল ৯:৪৫ মিনিটে কাসা সান্তা মার্তা থেকে পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, “পোপ ফ্রান্সিস আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে সুসমাচারের মূল্যবোধকে বিশ্বস্ততা, সাহস এবং সর্বজনীন ভালোবাসার সঙ্গে জীবনযাপন করতে হয়, বিশেষ করে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের পক্ষে।”
ভ্যাটিকান রেডিও আরও জানায়, হোলি সি প্রেস অফিসের ডিরেক্টর মাত্তেও ব্রুনি সাংবাদিকদের জানান, পোপের মরদেহ ২৩ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার সকালে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় স্থানান্তরিত হতে পারে, যাতে বিশ্বাসীরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। তিনি বলেন, “কার্ডিনালদের প্রথম কংগ্রিগেশনের পর আগামীকাল এই ব্যবস্থার বিস্তারিত ঘোষণা করা হবে।”
ভ্যাটিকান রেডিওর প্রতিবেদন অনুসারে, পোপ ফ্রান্সিস ২০২৪ সালের এপ্রিলে পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার লিটার্জিকাল বইয়ের একটি আপডেটেড সংস্করণ অনুমোদন করেন। আর্চবিশপ দিয়েগো রাভেল্লি, মাস্টার অফ অ্যাপোস্টলিক সেরেমনিস, জানান, পোপ ফ্রান্সিসের ইচ্ছা ছিল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সরলীকৃত হবে এবং এটি গির্জার পুনরুত্থিত খ্রিস্টের প্রতি বিশ্বাস প্রকাশ করবে। তিনি বলেন, “নবায়নকৃত আচারটি এই কথা জোর দেয় যে রোমান পন্টিফের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া একজন পাষ্টর এবং খ্রিস্টের শিষ্যের জন্য, এটি এই পৃথিবীর কোনো ক্ষমতাশালী ব্যক্তির জন্য নয়।”

সিএনএন-এর প্রতিবেদক ইভানা কোটাসোভা এবং মাইকেল উইলিয়ামস জানিয়েছেন, পোপ ফ্রান্সিস তার জীবনের শেষ মাসগুলোতে অভিবাসীদের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির তীব্র সমালোচনা করেন। ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকান বিশপদের কাছে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেন, “যারা চরম দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা, শোষণ, নিপীড়ন বা পরিবেশের গুরুতর অবনতির কারণে নিজ ভূমি ছেড়ে গেছে, তাদের বিতাড়নের কাজ অনেক নারী-পুরুষের মর্যাদাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।”
সিএনএন আরও জানায়, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, যিনি ২০১৯ সালে ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন, ন্যাশনাল ক্যাথলিক প্রেয়ার ব্রেকফাস্টে পোপের এই সমালোচনার জবাব দেন। তিনি বলেন, “পোপ ফ্রান্সিস আমাদের অভিবাসন নীতির কিছু বিষয়ে সমালোচনা করেছেন। আমার উদ্দেশ্য তাঁর বা অন্য কোনো ধর্মযাজকের সঙ্গে কে সঠিক বা ভুল তা নিয়ে বিতর্ক করা নয়। আমি আমার মতামত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করব কারণ আমি মনে করি এটি আমেরিকান জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থে।”
সিএনএন-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ভ্যান্স এবং পোপ ফ্রান্সিস রোববার সংক্ষিপ্তভাবে সাক্ষাৎ করেন, যা বন্ধুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। তবে শনিবার ভ্যান্স ভ্যাটিকানের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যেখানে অভিবাসী, শরণার্থী এবং বন্দীদের বিষয়ে “মতামতের আদান-প্রদান” হয়।

সিএনএন-এর প্রতিবেদক কেভিন লিপটাক জানিয়েছেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা পোপ ফ্রান্সিসকে “এমন একজন বিরল নেতা” হিসেবে স্মরণ করেন যিনি “আমাদের আরও ভালো মানুষ হতে উৎসাহিত করেছেন।” তিনি বলেন, “তাঁর নম্রতা এবং সরল অথচ গভীর অঙ্গভঙ্গি—অসুস্থদের আলিঙ্গন, গৃহহীনদের সেবা, তরুণ বন্দীদের পা ধোয়া—আমাদের নিশ্চুপতা থেকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে এবং আমাদের স্মরণ করিয়েছে যে আমরা সকলেই ঈশ্বর ও একে অপরের প্রতি নৈতিক দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ।”


সিএনএন আরও জানায়, ২০১৫ সালে পোপ ফ্রান্সিসের মার্কিন সফরের সময় ওবামা তাঁকে জয়েন্ট বেস অ্যান্ড্রুজে অভ্যর্থনা জানাতে যান। পরে পোপ হোয়াইট হাউসের সাউথ লনে ওপেন-এয়ার পোপমোবাইলে একটি সংক্ষিপ্ত প্যারেডে অংশ নেন, যেখানে হাজার হাজার মানুষ তাঁকে দেখতে সমবেত হন।


এপি নিউজের প্রতিবেদন অনুসারে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, যিনি একটি প্রধানত ক্যাথলিক দেশের নেতা, এক্স-এ লেখেন, “বুয়েনস আইরেস থেকে রোম পর্যন্ত, পোপ ফ্রান্সিস গির্জাকে আনন্দ ও আশা নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন দরিদ্রদের জন্য। … এই আশা চিরকাল তাঁকে অতিক্রম করুক।”

এপি নিউজের নিকোল উইনফিল্ড জানিয়েছেন, পোপ ফ্রান্সিস ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ ২৬৬তম পোপ হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি তার প্রথম অভিবাদনে “বুওনাসেরা” (গুড ইভনিং) বলে বিশ্বকে অবাক করেন এবং নম্রতার একটি নতুন সুর প্রবর্তন করেন। তিনি শরণার্থী এবং প্রান্তিক মানুষদের প্রতি তার সমর্থনের জন্য পরিচিত ছিলেন। তবে তার প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, এলজিবিটিকিউ+ ক্যাথলিকদের প্রতি সহানুভূতি এবং ঐতিহ্যবাদীদের উপর নিষেধাজ্ঞার কারণে রক্ষণশীলদের সঙ্গে তার সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়।
এপি নিউজ আরও জানায়, ২০১৮ সালে চিলিতে যাজকদের যৌন নির্যাতনের একটি কেলেঙ্কারি মোকাবেলায় তিনি ভুল পদক্ষেপ নেন, যা তার পূর্বসূরিদের সময়ে উদ্ভূত একটি সমস্যাকে পুনরায় উত্থাপন করে। করোনাভাইরাস মহামারীর সময় তিনি ভ্যাটিকান সিটি থেকে বিশ্ব ধর্মের নেতৃত্ব দেন এবং ২০২০ সালের মার্চে ফাঁকা সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে বলেন, “আমরা বুঝতে পেরেছি যে আমরা সকলে একই নৌকায়, সকলেই ভঙ্গুর এবং দিশেহারা।” তিনি মহামারীকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো পুনর্বিবেচনার সুযোগ হিসেবে দেখতে আহ্বান জানান।

সিএনএন-এর কেভিন লিপটাক জানিয়েছেন, হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট বলেছেন, বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় রোমে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে তিনি সম্ভাবনাটি উড়িয়ে দেননি, বলেন, “এর মানে এই নয় যে এটি হবে না।” তিনি আরও বলেন, “আমরা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ খ্রিস্টানদের জন্য প্রার্থনা করছি যারা পোপকে ভালোবাসতেন এবং তাঁর প্রশংসা করতেন।”
সিএনএন জানায়, সর্বশেষ পোপ জন পল দ্বিতীয়ের মৃত্যুর সময় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন।

পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যু বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক সম্প্রদায় এবং তার বাইরেও গভীর শোকের সৃষ্টি করেছে। তার নম্রতা, প্রান্তিক মানুষদের প্রতি সহানুভূতি এবং সুসমাচারের মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকার তাকে একজন বিরল নেতা হিসেবে স্মরণীয় করে রেখেছে। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রস্তুতি এবং বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া তাঁর জীবনের প্রভাবের প্রতিফলন ঘটায়।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version