রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে কৃষ্ণ সাগরে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সম্পন্ন হয়েছে, যা এই অঞ্চলে দীর্ঘদিনের সংঘাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে, এই চুক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা, এর শর্তাবলী এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ পেয়েছে।
বিবিসি জানিয়েছে, রাশিয়া এবং ইউক্রেন কৃষ্ণ সাগরে একটি নৌ-যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এই চুক্তি সমুদ্রপথে উত্তেজনা কমানোর একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। একইভাবে, দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তির মধ্যস্থতা করেছে, যার লক্ষ্য কৃষ্ণ সাগরে সংঘর্ষ বন্ধ করা। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস হোয়াইট হাউসের বরাত দিয়ে নিশ্চিত করেছে যে উভয় দেশ এই অঞ্চলে যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি হয়েছে। রয়টার্স আরও জানিয়েছে, এই চুক্তির মাধ্যমে কৃষ্ণ সাগরে নিরাপদ নৌযান নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
এবিসি নিউজ হোয়াইট হাউসের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, রাশিয়া এবং ইউক্রেন কৃষ্ণ সাগরে “শক্তি প্রয়োগ বন্ধ” করতে সম্মত হয়েছে। ফক্স নিউজ এবং পলিটিকো উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনার ফলে এই যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। নিউ ইয়র্ক পোস্ট এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতে এটি একটি “ট্রুস” বা সাময়িক শান্তি চুক্তি।
কেএসএল ডটকম জানিয়েছে, এই চুক্তি কেবল সমুদ্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং জ্বালানি খাতেও একটি ট্রুস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া, ওয়াশিংটন এই চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার চেষ্টা করছে। কিয়েভ ইন্ডিপেনডেন্ট ক্রেমলিনের বরাতে জানায়, এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে কিছু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর। এনডিটিভি এই চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়া যে সুবিধাগুলো পেতে পারে, তার একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে, যা এই সমঝোতার পেছনে রাশিয়ার সম্ভাব্য উদ্দেশ্য নির্দেশ করে।
ইউক্রেইনস্কা প্রভদা হোয়াইট হাউসের বক্তব্য উল্লেখ করে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার কৃষি রপ্তানিতে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা এই চুক্তির একটি অংশ হতে পারে। সিএনবিসি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সমুদ্রে ট্রুসের পাশাপাশি জ্বালানি আক্রমণ নিষিদ্ধ করার বিষয়েও সম্মতি হয়েছে। ইউএন নিউজ জানিয়েছে, জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস ইউক্রেন ও রাশিয়ায় জ্বালানি আক্রমণ বন্ধের চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন, যা এই যুদ্ধবিরতির সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে।
দ্য মস্কো টাইমস জানিয়েছে, রাশিয়ার একজন আলোচক এই আলোচনাকে “উপযোগী” বলে অভিহিত করেছেন এবং জাতিসংঘের সম্ভাব্য ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। সিবিএস নিউজ রাশিয়ার বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সীমিত যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা “খুবই উপযোগী” হয়েছে, তবে এখনও বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। ফ্রান্স ২৪ ইংলিশ ক্রেমলিনের বরাতে জানিয়েছে, রিয়াদে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া আলোচনার বিষয়বস্তু “নিশ্চিতভাবে প্রকাশিত হবে না”।
লে মন্ড প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি নিয়ে ১২ ঘণ্টার আলোচনা শেষ হয়েছে। কিয়েভ পোস্ট জানিয়েছে, সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন আলোচনার দ্বিতীয় দফা সমাপ্ত হয়েছে। রেডিও ফ্রি ইউরোপ/রেডিও লিবার্টি রিয়াদে অনুষ্ঠিত আলোচনার মূল ফলাফল তুলে ধরেছে।
সিএনএন বিশ্লেষণে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি সফল করলেও ক্রেমলিনের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। দ্য গার্ডিয়ান মন্তব্য করেছে, এই যুদ্ধবিরতি “রাশিয়ার ইচ্ছাপূরণের তালিকার মতো” মনে হচ্ছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় মোড়ক দেওয়া হয়েছে। ইউএসএ টুডে সতর্ক করে বলেছে, রাশিয়া অতীতেও কৃষ্ণ সাগরে যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা পালিত হয়নি।
দ্য টেলিগ্রাফ মত প্রকাশ করেছে, কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার দুর্বল অবস্থানই তাদের এই যুদ্ধবিরতির প্রতি আগ্রহী করেছে। ফিনান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া আলোচনা ইউরোপে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট উল্লেখ করেছে, ট্রাম্পের দূতের আশাবাদ সত্ত্বেও রাশিয়া দ্রুত অগ্রগতির সম্ভাবনা কমিয়ে দিয়েছে।
ভিন্নমত ও শর্ত কি কি দেখা যায় ?
দ্য হিল জানিয়েছে, রাশিয়া সর্বশেষ আলোচনায় কোনো চুক্তি হয়নি বলে দাবি করেছে, যা অন্যান্য প্রতিবেদনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অ্যাক্সিওস বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও রাশিয়া নতুন শর্ত আরোপ করেছে। ইয়াহু জানিয়েছে, রাশিয়া বলেছে তারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে যদি যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে “নির্দেশ” দেয়।
স্কাই নিউজ এই চুক্তির বিষয়বস্তু এবং তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছে, এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এবিসি নিউজ বলেছে, আলোচনা “কিছুই না” নিয়ে হয়েছে বলে এটি আবার ব্যর্থ হয়েছে। ডিডব্লিউ (ইংলিশ) মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে এই যুদ্ধবিরতির খবর নিশ্চিত করেছে। দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষ শক্তি প্রয়োগ বন্ধে রাজি হয়েছে।
ইউরোনিউজ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। অয়েলপ্রাইস ডটকম বলেছে, রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার বিস্তারিত প্রকাশ করছে না। সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি অ্যানালাইসিস রাশিয়ার আলোচকের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছে।
কৃষ্ণ সাগর যুদ্ধবিরতি নিয়ে রাশিয়া, ইউক্রেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান আলোচনা একটি জটিল কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত দেয়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই চুক্তি সমুদ্রে শান্তি ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে। তবে, রাশিয়ার শর্ত, অতীতের অভিজ্ঞতা এবং ইউরোপের উদ্বেগ এই চুক্তির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এটি কূটনৈতিক সাফল্য হয়ে উঠবে, নাকি সাময়িক সমঝোতায় পরিণত হবে, তা সময়ই বলে দেবে।