নিজস্ব প্রতিবেদক 

মাগুরায় আট বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় চার আসামির রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে গত রোববার গভীর রাতে এই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। মাগুরার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল মতিনের আদেশে মূল অভিযুক্ত শিশুটির বোনের শ্বশুরকে সাত দিন এবং তার স্বামী, শাশুড়ি ও ভাশুরকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নারী-শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। 

প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার মাগুরা শহরতলির নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে এই শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। পরিবারের অভিযোগ, শিশুটির বোনের শ্বশুর, স্বামী, শাশুড়ি ও ভাশুর এই জঘন্য কাণ্ডে জড়িত। ঘটনার পর শিশুটিকে প্রথমে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। বর্তমানে শিশুটি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন। 

গত শনিবার শিশুটির মা মাগুরা সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন। মামলায় চার আসামিকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ তাদের আদালতে হাজির করে। তবে, গত রোববার দিনভর বিক্ষোভের কারণে আসামিদের আদালতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে রাত ১২টার পর শুনানি শুরু হয়। 

 রাতের শুনানি রিমান্ড 

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আসামিদের সাত দিন করে রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানিতে আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না। আদালত আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিলে তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন এবং রিমান্ড না দেওয়ার আহ্বান জানান। তবে, তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ভুক্তভোগী শিশু অচেতন থাকায় তার জবানবন্দি নেওয়া যায়নি। তাই আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা যাচাই জরুরি। উভয় পক্ষের যুক্তি শুনে বিচারক মূল অভিযুক্তকে সাত দিন এবং বাকি তিনজনকে পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, “দিনভর আন্দোলনকারীরা আদালতের ফটক ঘিরে রেখেছিল। আসামিদের তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি উঠেছিল। তাই নিরাপত্তার জন্য রাতে শুনানি করা হয়।” 

 মাগুরায় দিনভর বিক্ষোভ 

এ ঘটনার প্রতিবাদে গত রোববার মাগুরা শহরে সকাল থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা আদালতের ফটক অবরোধ করেন। বেলা ১১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান নেন। এরপর বিকেলে ভায়না মোড় মহাসড়ক বন্ধ করে দেন আন্দোলনকারীরা। সন্ধ্যার পর শহরে মশাল মিছিল বের হয়। আন্দোলনকারীরা আসামিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানান। এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পুলিশ আসামিদের দিনে আদালতে হাজির করার ঝুঁকি নেয়নি। 

 দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় 

মাগুরার এই ঘটনা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। তারা বলছেন, “দেশে ধর্ষণের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। আট বছরের শিশুও নিরাপদ নয়। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেই।” তারা আসামিদের দ্রুত বিচার ও আইনশৃঙ্খলার উন্নতির দাবি জানান। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ প্ল্যাটফর্মের ব্যানারে লাঠি মিছিল হয়েছে। রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু করে শাহবাগ পর্যন্ত এই মিছিলে শিক্ষার্থী ও সামাজিক সংগঠনের সদস্যরা অংশ নেন। তারা স্লোগান দেন, “ধর্ষকদের বিচার করো, নিরাপত্তা নিশ্চিত করো।” বিক্ষোভকারীরা বলছেন, “অভ্যুত্থানের পরও নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।” 

এছাড়া, সারা দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানববন্ধন, মিছিল ও সমাবেশ চলছে। ছাত্র সংগঠনগুলো ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগের দাবি তুলেছে। 

 সরকারের পদক্ষেপ  কি ?

চলমান পরিস্থিতির মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ গ্রহণের জন্য টোল ফ্রি হটলাইন চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এটি জনগণের ক্ষোভ কিছুটা প্রশমনের চেষ্টা হলেও, অনেকে মনে করছেন, আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। 

 শিশুটির অবস্থা 

ডেইলি স্টার বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিশুটিকে গত রোববার লাইফ সাপোর্ট থেকে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে, প্রথম আলোর সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, তার অবস্থা এখনো অপরিবর্তিত। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শিশুটি বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। 

 সমাজে ধর্ষণের চিত্র 

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে ৬ হাজার ২৭২ জন নারী ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এ বছরের জানুয়ারিতে ৩৯ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এই পরিসংখ্যান নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার ভয়াবহতা তুলে ধরে। 

 মাগুরার এই ঘটনা কেবল একটি বিচ্ছিন্ন কাণ্ড নয়, বরং দেশে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তাহীনতার একটি প্রতিচ্ছবি। জনগণের প্রতিবাদ ও ক্ষোভ থেকে স্পষ্ট, তারা দ্রুত বিচার ও কার্যকর সমাধান চায়। সরকার ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। 

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version